10/01/2025 ডিলিট বাটনে মুছে যাওয়া মানবিকতা, রিসেট বাটনে আমিত্বের গ্লানি এবং স্মার্টফোনের স্ক্রিনে মৃত বিবেক
odhikarpatra
১ অক্টোবর ২০২৫ ১৫:৪৩
বিশেষ সম্পাদকীয়
স্ক্রিনে মুখ, হৃদয়ে শূন্যতা! ডিজিটাল যুগে মনুষ্যত্বের মৃত্যু ও আত্মকেন্দ্রিক সমাজের করুণ প্রতিচ্ছবি, যেখানে সম্পর্ক হারায় লাইক, ভালোবাসা হারায় ইমোজিতে, আর বিবেক হারিয়ে যায় স্ক্রলের শব্দে।
সন্ধ্যা নেমেছে শহরের পশ্চিম কোণে। একটি পুরনো চা দোকানে বসে আছেন এক বৃদ্ধ, নিঃসঙ্গ ও নীরব। কাচের গ্লাসে ধোঁয়া ওঠা চায়ের মতোই তাঁর নিঃশ্বাস ওঠে—ধীরে, ভারী, নিঃশব্দে। আশেপাশে তরুণদের ভিড়, অথচ কেউ তাঁর দিকে তাকায় না। কেউ বোঝে না, এই মানুষটিই একদিন ছিলেন এলাকার আলোকবর্তিকা, এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, যাঁর স্পর্শে মানুষ গড়ে উঠত। আজ তিনি কেবলই একটি অব্যবহৃত বস্তু, যাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
এই দৃশ্য আজ সমাজের এক দৈনন্দিন বাস্তবতা। আমরা সবাই আছি, তবু কেউ নেই। সম্পর্ক আছে, অথচ সংযোগ নেই। মুখোমুখি হলেও চোখে চোখ পড়ে না—পড়ে শুধু স্ক্রলের একঘেয়ে শব্দ। হৃদয় যেন এখন এক গ্যাজেট—চার্জ দিতে হয়, আপডেট করতে হয়, আর না পসন্দ হলেই ডিলিট। সম্পর্ক এখন এক ক্লিকের ব্যাপার—একটু ভুল বোঝাবুঝি, একটুখানি বিরক্তি, ব্যস, ‘ব্লক’। যেন মানুষ নয়, মোবাইলের অ্যাপ—প্রয়োজন শেষ তো আনইনস্টল।
আমাদের এই নতুন সংস্কৃতি—রিসেট কালচার—আমিত্বকে যেভাবে দেবতায় পরিণত করেছে, তাতে অন্য কেউ ঠাঁই পায় না। আমরা বিশ্বাস করি, যদি তাতে আমার উপকার না থাকে, তবে তার অস্তিত্বেরও প্রয়োজন নেই। এই আমি এতটাই আধিপত্যশীল যে, পাশের কেউ দুঃখ পেলে আমরা তাকে দায়িত্ব নয়, বিরক্তি মনে করি। একজন বৃদ্ধ রাস্তায় পড়ে থাকলে আমরা ক্যামেরা চালু করি, হৃদয় নয়।
সমাজ এক সময় বলত, “মানুষ মানুষের জন্য।” আজ সেই উক্তির মানে বদলে গেছে—মানুষ এখন কনটেন্টের জন্য। কেউ কাঁদছে? তার ছবি তুলো। কেউ কষ্টে? শেয়ার করো, লিখো—‘Heartbreaking’। অথচ, পাশে গিয়ে জিজ্ঞেস করি না, "কিছু লাগবে?" আজ সাহায্যের হাত নেই, আছে ক্যামেরার ফ্রেম। আজ পাশে দাঁড়ানো মানে সহানুভূতি নয়—ভিউস বাড়ানো। সেই সহানুভূতি আজ নিঃস্ব, বিবেক নির্বাক।
ফেসবুকে লেখা ভালোবাসার ছড়া আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে না, ইমোজির হাসিমুখ আবেগের প্রতীক নয়। গ্যালারিতে মুখের অসংখ্য ছবি জমে, অথচ জীবনে একটিও সত্যিকারের মুখ হয়তো আমাদের হৃদয়ে জায়গা পায় না। আজ আমরা স্মার্টফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকি, কিন্তু আত্মার দরজা বন্ধ। আমাদের মেমোরি ফুল, অথচ অনুভূতির ড্রাইভ শূন্য।
এই সমাজে একটি বাচ্চা ক্ষুধার্ত থাকলে আমরা তা দেখতে পাই ভিডিওতে, কিন্তু আমাদের রুটি ভাগ করতে ইচ্ছে করে না। একটি পরিবার পথে বসে গেলে আমরা জানি তার লোকেশন, কিন্তু জানি না তার দুঃখ। প্রযুক্তির আলোতে আমরা আলোকিত, কিন্তু হৃদয়ের অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলেছি।
তাই এখনই সময়—ফিরে দেখার, নিজেকে প্রশ্ন করার। মানুষকে ডিলিট করা যায়, কিন্তু মনুষ্যত্বকে কি মুছে ফেলা যায়? আমরা যদি আজ একটুখানি মনোযোগ দিই, একটুখানি সহানুভূতি দেখাই—তবে হয়তো কারো জীবনে ফিরিয়ে দিতে পারি আলো। আজ যে বৃদ্ধ নিঃসঙ্গ, কাল তিনি আমরা হতে পারি। আজ যে কিশোর ক্ষুধার্ত, সে আমাদের সন্তানের ছায়া।
প্রযুক্তি আমাদের এগিয়ে নিয়ে গেছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই পথ যেন আমাদের মানুষ না বানিয়ে, প্রোফাইল বানিয়ে না তোলে। তাই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে—আমরা কি হবো ফিল্টারপরায়ণ, মুখোশপরা প্রোফাইল? না কি হৃদয়বান, সম্পর্ক নির্ভর মানুষ?
ভিউ নয়, ভ্যালু জরুরি। সম্পর্কের উষ্ণতা, ভালোবাসার ছোঁয়া, শ্রদ্ধার স্থান—এইগুলিই ফিরিয়ে দিতে পারে হারিয়ে যাওয়া সমাজকে। মানুষকে ব্লক নয়, ভালোবেসে জায়গা দিন জীবনের স্ক্রিনে। কারণ, মনুষ্যত্বের কোনো ডিলিট বাটন থাকা উচিত নয়।
স্ক্রিন নয়, স্পর্শ ফিরিয়ে দিন্। প্রযুক্তি আমাদের উপকার করেছে—তবে তা যেন আমাদের মানুষ না থাকার অজুহাত না হয়। আমাদের বেছে নিতে হবে—আমরা কি মুখোশ পরা একাকী প্রোফাইল হবো, না হৃদয়বান মানুষ?
যে সমাজ একদিন "মানুষ" শব্দে গর্ব করত, সে সমাজকে ফিরিয়ে আনতে হলে এখনই থামতে হবে। বুঝতে হবে, 'ভিউ' নয়, 'ভ্যালু' জরুরি।মানুষকে মুছে না ফেলে—তাকে ভালোবেসে জায়গা দিতে হবে আমাদের জীবনের স্ক্রিনে। কারণ মনুষ্যত্বের কোনো রিসেট বাটন থাকা উচিত নয়।
লেখক: অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপদেষ্টা সম্পাদক, odhikarpatranews@gmail.com