10/20/2025 From Darkness to Divinity - দীপাবলি ও শ্যামা পূজা — কালরাত্রির অন্ধকারে আলো, শক্তিতে মুক্তি
odhikarpatra
২০ October ২০২৫ ১৭:২৫
(অধিকারপত্র সম্পাদকীয় — ২০ অক্টোবর ২০২৫)
আজ অমাবস্যার রাত্রি। গগনের কালো আচ্ছাদনে মর্ত্যের বুক জুড়ে জ্বলে উঠেছে অসংখ্য দীপশিখা। আজ দীপাবলি—আলোয় অন্ধকারের তিরোধানে আলোর জয়গাথা। আজই শ্যামা পূজার মহারাত্রি—অধর্ম, অজ্ঞান ও অন্যায় বিনাশের তপস্যাময় অনুষ্ঠানিকতা।
আজকের এই দিনটি আলো ও অন্ধকারের চিরন্তন দ্বন্দ্বের প্রতীকরূপে বিরাজমান। দীপাবলির দীপশিখা যেভাবে তমসাচ্ছন্ন পৃথিবীতে আলোর জাগরণের আহ্বান জানায়, তদ্রূপ শ্যামাপূজার মহাকালরাত্রি আদ্যাশক্তি মহামায়া কালী মাতার তপস্যাময় আবির্ভাব—অন্যায়, অজ্ঞান ও বিভেদের বিনাশের পরম প্রতীক।
সনাতন ধঘর্মাবলম্বীদের বিশেষ রাত। যে অনাদিকাল থেকে সৃষ্টি, সেই প্রণব অঙ্কারে ছিল জগৎজীবনের মূল সুর। সনাতন দর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, “ওঁ”—এই অঙ্কারই আদিশক্তির প্রথম স্পন্দন। এই অঙ্কার থেকেই শিব ও শক্তির ঐক্য, সৃষ্টি ও বিনাশের মহাতত্ত্বের আবির্ভাব। সেই শক্তিরই মূর্ত রূপ আদ্যাশক্তি কালী—যিনি কালো অন্ধকারের মাঝে জ্বালান জ্ঞানালোকের দীপ, যিনি ধ্বংসের মধ্য দিয়াই সৃজনের নবপথ রচনা করেন।
যখন জগতে অধর্মের আধিক্য, লোভ, হিংসা ও অন্যায়ে মানবতা লুপ্তপ্রায় হয়, তখনই মা কালী প্রকাশিত হন তাঁর ভয়ংকর রূপে—শুভের প্রতিষ্ঠা ও অশুভের বিনাশে। তাঁর কণ্ঠে বজ্রধ্বনি, তাঁর নয়নে করুণার দীপ্তি। তিনি ধ্বংসের দেবী নন, তিনি পরিত্রাণের মাতা।
দীপাবলির প্রদীপ যেমন বাহিরের অন্ধকারে আলো ছড়ায়, তেমনি শ্যামা পূজার আরাধনা অন্তরের অন্ধকার দূর করে। এই দুই উৎসবের অন্তর নিহিত আছে এক অনন্ত বার্তা—“আলো জ্বালো, শক্তিকে জাগাও।”
আজকের এই যুগে, যেখানে অন্যায় ও বিভাজনের বিষধারা সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে কালী মায়ের আরাধনা কেবল মন্ত্রোচ্চারণে সীমাবদ্ধ নয়—এ এক নৈতিক আহ্বান। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সত্যের পক্ষে অবিচল অবস্থানই আজকের যুগধর্ম।
মহাকালী রক্তমাখা জিহ্বায় অশুভের বিনাশ ঘোষণা করেন, আবার সেই মায়ের হাসিতে জেগে ওঠে মুক্তির দীপ। তাঁর অন্ধকার রূপের অন্তরে জ্বলে অনন্ত আলোর প্রতীক।
বর্তমান সমাজ জীবনে নেমে এসেছে এক অদ্ভুত অস্থিরতার ছায়া। মানুষ যেন ক্রমে হারিয়ে ফেলছে অন্তরের আলোক, মমতা ও ন্যায়ের বোধ। বিভাজন, হিংসা, লোভ ও অবিশ্বাসের কালো মেঘে আজ মানবতার আকাশ আচ্ছন্ন। এমনই এক সময়ে দীপাবলি ও শ্যামা পূজার আবির্ভাব—যেন অন্ধকারের বুক চিরে আলোর আহ্বান। দীপাবলির দীপশিখা আমাদের শেখায়, ক্ষুদ্র আলোও পারে গভীরতম আঁধার ভেদ করতে; আর শ্যামা পূজার রাত্রি স্মরণ করায়, ধ্বংসই নবসৃষ্টির ভূমিকা। মা কালী অশুভের বিনাশিণী, কিন্তু সেই ধ্বংসে লুকিয়ে থাকে মায়েরই করুণ দৃষ্টি—যে দৃষ্টি মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের পথে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান জানায়। আজকের যুগে, যখন মানবহৃদয় শূন্যতা ও ভয়ে জর্জরিত, তখন দীপাবলির প্রদীপ ও শ্যামা মায়ের তেজ একত্রে যেন এক অন্তর্জাগরণের বার্তা বহন করে—“অন্তরে আলো জ্বালো, মন্দকে বিনাশ করো, আর মানবতার শিখা পুনরায় প্রজ্বলিত করো।”
শেষ পর্যালোচনায় বলা যায়—দীপাবলি ও শ্যামা পূজা কেবল উৎসব নয়, মানব আত্মার গভীর জাগরণের প্রতীক। আলো ও অন্ধকার, সৃষ্টি ও ধ্বংস, শুভ ও অশুভের এই চিরন্তন দ্বন্দ্বেই লুকিয়ে আছে জীবনের মূল তত্ত্ব। আজকের বিভ্রান্ত সমাজে, যেখানে মানুষ আত্মভোলা ও মূল্যবোধশূন্য, সেখানে এই দুই উৎসব আমাদের মনে করিয়ে দেয়—প্রকৃত আলোক কোনো প্রদীপে নয়, তা জ্বলে মানুষের হৃদয়ে। মা কালী সেই অন্তরের শক্তির প্রতীক, যিনি অন্যায়ের বিনাশ ঘটিয়ে মানুষকে নিজের অন্তরচক্ষে সত্য ও ন্যায়ের পথ দেখান। দীপাবলির আলো তাই বাহিরে নয়, অন্তরে জ্বালাতে হয়; অন্ধকারকে জয় করতে হয় নিজের ভেতর থেকেই। এই উপলব্ধিই আজকের সমাজে সবচেয়ে প্রয়োজনীয়—যাতে ধ্বংসের মাঝেও জেগে ওঠে সৃষ্টির গান, আর আলো জ্বলে প্রতিটি হৃদয়ে।
এই দীপাবলির রাত্রিতে, এই শ্যামা পূজার মুহূর্তে, আসুন আমরা প্রত্যেকে অন্তরে জ্বালাই সেই আলোকশিখা—যা অহংকার নয়, যা ক্ষমা; যা ধ্বংস নয়, যা সৃজন।
অঙ্কারে আলো, শক্তিতে মুক্তি—এই হোক আমাদের অন্তরযাত্রার মন্ত্র।
—অধ্যাপক ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা্ সম্পাদক, অধিকারপত্র
#দীপাবলি_শ্যামা_পূজা #আদিশক্তি_কালী #অন্যায়ের_বিনাশ #আলো_ও_অন্ধকার