11/18/2025 নিরাপত্তার বাইরে খেলাটাই কি হারাচ্ছে: বাংলাদেশে নারী ক্রীড়াবিদদের ভয়, প্রতিবাদ এবং ন্যায়বিচারের পথে লুকোনো লড়াই
Dr Mahbub
১৮ November ২০২৫ ১০:৫৬
বাংলাদেশের টেনিস, ক্রিকেট, শুটিং, ফুটবল ও সাঁতার জুড়ে নারী ক্রীড়াবিদদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি, মানসিক নির্যাতন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বাস্তব ঘটনা, কাঠামোগত দুর্বলতা, নীরবতার সংস্কৃতি এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার নিয়ে একটি গভীর অনুসন্ধানমূলক ফিচারধর্মী উপসম্পাদকীয়।
ঢাকার ভোরে মিরপুরের একাডেমি মাঠে বল গড়ানোর আগে কয়েকজন নারী ক্রিকেটার নিজেদের মধ্যে থমকে দাঁড়ান। চোখে ক্লান্তির ছাপ নেই, আছে আরেক রকম প্রশ্ন—আজ তারা কি সত্যিই নিরাপদ?
এই প্রশ্ন মাঠের নয়, জীবনের। ক্রিকেট থেকে ফুটবল, শুটিং থেকে সাঁতার, বাংলাদেশের প্রতিটি ক্রীড়া শাখায় নারীর উপস্থিতি বাড়লেও তাদের ভরসার জায়গাটি দিন দিন আরও অনিরাপদ হয়ে উঠছে। এই প্রশ্ন হঠাৎ তৈরি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে জমা হওয়া ভয়ের শেকড় আছে এর পিছনে।
২০১৮ সালে বিবিসি প্রচার করেছিলো একটি অনুসন্ধান— “ক্রীড়াঙ্গনে ধর্ষণ: ক্রীড়া ক্যাম্পগুলোতে নারী খেলোয়াড়রা কতটা নিরাপদ?”। সেই প্রতিবেদনে উঠে আসে বাংলাদেশের এক নারী ভারোত্তোলককে ধর্ষণের অভিযোগের বর্ণনা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এমন গুরুতর বিষয় প্রকাশ পাওয়ার পরও দেশে কার্যকর কোনো শাস্তি বা সংস্কার দেখা যায়নি। শাস্তি না থাকায় নিপীড়কদের দৌরাত্ম্য কেবল বাড়তেই থেকেছে। নিরাপত্তাহীনতা তখন থেকে আরও স্পষ্ট, আরও দৃঢ়। ফলে এখন ক্রিকেট, ফুটবল, শুটিং, সাঁতার—প্রায় সব ক্রীড়া শাখায় নারীরা অনিশ্চয়তা নিয়ে মাঠে নামেন। খেলা তাদের ডাকে, কিন্তু ভয়ও পিছু নেয়। এই অনিরাপত্তার গল্প শুধু ঘটনার পরম্পরা নয়, এটি ভয়, নীরবতা, সাহস, অন্যায় আর ক্ষমতার আঁধার দিয়ে গড়া এক নির্মম বাস্তবতা।
২০১৯ সালের টেনিস ফেডারেশন কেলেঙ্কারি যেন এক সতর্কবার্তা। কিশোরী খেলোয়াড়কে যৌন হয়রানির অভিযোগে সাধারণ সম্পাদক বরখাস্ত হলেও শাস্তি হয়নি কোনো পর্যায়ে। আদালত পর্যন্ত যাওয়া মামলা প্রমাণ করে দেয়, অভিযোগ থাকলেও কাঙ্ক্ষিত বিচার আসে না সহজে। এই ঘটনা নারী খেলোয়াড়দের মনে একটি কথা স্থায়ী করে দেয়। অভিযোগ মানে ঝুঁকি। অভিযোগ মানে ক্যারিয়ার শেষ। তাই নীরবতা হয়ে ওঠে অভ্যাস, পরে প্রথা, আর আজ প্রায় প্রতিষ্ঠানিক নীতি।
জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের অভিজ্ঞ পেসার জাহানারা আলম যখন নির্বাচক ও টিম ইনচার্জের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ আনেন, তখন দেশের ক্রীড়া মহলে চাপা থাকা শব্দটি ভেঙে বাইরে আসে। জাহানারা বলেন, দীর্ঘদিনের নির্যাতন তাকে মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছে। অভিযোগের পর তদন্তের প্রতিশ্রুতি এলেও তা রইল ধীর, অস্বচ্ছ এবং অপ্রকাশিত। যেন সময়ই সবচেয়ে বড় ঢাল।
তারকা শুটার কামরুন্নাহার কলি সামাজিক মাধ্যমে লিখলেন এমন কথা যা কেউ বলার সাহস পাননি। প্রতিদিন মানসিক অপমান, টানা চাপ, সিন্ডিকেটের চাপসৃষ্টি, প্রভাবশালীদের পক্ষপাত। এ কথা প্রকাশ্যে আনতেই তিনি শোকজ হন। সত্য উচ্চারণের প্রতিদান হয়ে যায় শাস্তির হুমকি। এখানে পরিষ্কার দেখা যায় যে ক্রীড়াঙ্গনে নারীর প্রতিপক্ষ কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি নন। প্রতিপক্ষ হলো এক অদৃশ্য ক্ষমতাকাঠামো, যা নিজের সুবিধার জন্য নীরবতা বেছে নেয়।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় নারী ফুটবল দলের ১৮ জন খেলোয়াড় এক অভূতপূর্ব সাহসিকতা দেখান। তারা ইংলিশ কোচ পিটার বাটলারের বিরুদ্ধে বডি শেমিং, পোশাক ও শরীর নিয়ে অপমানজনক মন্তব্য, মানসিক নির্যাতনসহ নানা আচরণের অভিযোগ তোলেন। লিখিত অভিযোগ তদন্তের প্রতিশ্রুতি পেলেও পদক্ষেপ ছিল স্লো। উল্টো কিছু খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ ওঠে। ফেব্রুয়ারিতেই এ দলই পেল রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদক। একদিকে সম্মান। অন্যদিকে অপমানের ক্ষত। এই বৈপরীত্য বলে দেয় আমাদের সিস্টেম কতটা বিচ্ছিন্ন বাস্তবতা থেকে।
বিবিসির রিপোর্ট, মাহফুজা শিলার সাক্ষ্য এবং শিরিন সুলতানার অভিজ্ঞতা জানান দেয় যে সাঁতারের পুল থেকেও যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠে এসেছে বহুবার। একজন শীর্ষ নারী সাঁতারুকে ধর্ষণের অভিযোগ, বছরের পর বছর ফেডারেশন অভ্যন্তরে লুকনো বহু ঘটনা।
যে ক্যাম্প হওয়ার কথা ছিল স্বপ্নের সিঁড়ি, তা হয়ে ওঠে গোপন আতঙ্কের ঘর।
বিবিসির ২০১৮ সালের রিপোর্ট “ক্রীড়াঙ্গনে ধর্ষণ: ক্রীড়া ক্যাম্পগুলোতে নারী খেলোয়াড়রা কতটা নিরাপদ?”—এ প্রকাশিত হয় যে, “বাংলাদেশের এক নারী ভারোত্তোলককে কোচ ধর্ষণ করেছিলেন; এমনকি সুইমিং ফেডারেশনেও যৌন নিপীড়নের নজির রয়েছে।” _ সাঁতারু মাহফুজা শিলা এবং কোচ শিরিন সুলতানা জানিয়েছেন—এ ধরনের ঘটনা “নতুন কিছু নয়”, বরং বছরের পর বছর ধরে চলছে। কেউ কথা বলেন না, কারণ—অভিযোগ করলে যে ভয়গুলো তাড়া করে বেড়ায় সেগুলো খুব পরিচিত। বিভিন্ন নারী খেলোয়ারদের সাথে আলাপ করে মোটা দাগে চারটি কারণ পাওয়া যায়:
ফলে নারী ক্রীড়াবিদরা বুঝে যান, চুপ থাকাই নিরাপদ।
মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক স্বীকার করেছেন, বাজেট কম, লোকবল কম, কাঠামো দুর্বল। হাইকোর্টের বাধ্যতামূলক যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নির্দেশ মানছে না বেশিরভাগ ফেডারেশন। তাঁর মতে, “আমাদের সাংগঠনিক ভিত্তি দুর্বল, বাজেট স্বল্পতা, আইনি সীমাবদ্ধতা ও লোকবল সংকট রয়েছে।” অর্থাৎ, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নারী খেলোয়াড়দের জন্য কোনো সুরক্ষিত অভিযোগ প্রক্রিয়া বা সালিশি কাঠামো নেই। যেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হাইকোর্টের নির্দেশে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি বাধ্যতামূলক, সেখানে ৫০টিরও বেশি ক্রীড়া ফেডারেশনের অধিকাংশই তা মানছে না। যেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই কমিটি বাধ্যতামূলক, সেখানে ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোতে এর অস্তিত্বই নেই। কোনো জায়গায় খেলোয়াড়দের জন্য নিরাপদ অভিযোগ চ্যানেল নেই। ফেডারেশনই অভিযোগ পায়, তদন্তও করে, ফলও দেয়। এই কেন্দ্রীয় স্ববিরোধিতা নারী খেলোয়াড়দের আস্থাকে ধ্বংস করে দেয়।
২০২৩ সালের ফিফা নারী বিশ্বকাপের পর স্পেন ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট লুইস রুবিয়ালেস এক খেলোয়াড়কে অনিচ্ছাকৃতভাবে চুম্বন করার ঘটনায় শাস্তি পান—
বাংলাদেশে যদি এমন স্বচ্ছ তদন্তব্যবস্থা থাকত, তাহলে নারী অ্যাথলেটদের ভয় নয়, আস্থা জন্মাতো। আসলে, স্পেনের নারী বিশ্বকাপ বিজয়ের পর প্রেসিডেন্ট লুইস রুবিয়ালেসের বিতর্কিত আচরণের বিরুদ্ধে তদন্ত, আদালতের রায়, পদত্যাগ এবং শাস্তি প্রমাণ করেছে ন্যায়বিচার অসম্ভব নয়। বাংলাদেশেও এটি সম্ভব, যদি থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং স্বচ্ছ বিচার কাঠামো।
বাংলাদেশে যৌন হয়রানির অভিযোগ এখনো ফেডারেশননির্ভর প্রশাসনিক তদন্তে সীমিত, যা প্রায়ই প্রভাবিত হয় ‘সিন্ডিকেট রাজনীতি’ ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রভাব দ্বারা। তাই বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে ন্যায়বিচারের ঘাটতি পূরণের জন্য দরকার স্বাধীন ক্রীড়া সালিশি আদালত।
একটি স্বাধীন ক্রীড়া সালিশি আদালত (CAS-এর আদলে) স্থাপন করলে—
এছাড়া এই আদালত আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতো, যেমন IOC বা FIFA-এর স্বতন্ত্র সালিশি মডেল।
বাংলাদেশের নারী অ্যাথলেটরা শুধু পদক জেতার জন্য লড়েন না। তারা লড়েন নিজের মর্যাদা, সম্মান, আর শরীরের নিরাপত্তার জন্য।
তারা চান এমন একটি মাঠ, যেখানে প্রতিভা বিকশিত হবে, ভয় নয়। আর তাই বাংলাদেশের নারী ক্রীড়াবিদরা কেবল পদক নয়, মর্যাদা ও নিরাপত্তাও প্রাপ্য। আজ তারা যখন যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তখন তাঁরা কেবল ব্যক্তিগত ন্যায়বিচার নয়—একটি সুরক্ষিত, সম্মানজনক ক্রীড়া সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার দাবি তুলছেন।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের নারী অ্যাথলেটরা কেবল জয় বা পরিসংখ্যানের জন্য লড়েন না। তারা লড়েন নিজের মর্যাদা, স্বপ্ন, এবং শরীরের নিরাপত্তার জন্য। মাঠে তাঁরা প্রতিপক্ষ দেখেন, কিন্তু মাঠের বাইরে উত্তর দিতে হয় আরও কঠিন প্রশ্নকে—এই প্রতিষ্ঠান কি তাদের রক্ষা করতে পারবে? এই সিস্টেম কি তাদের বিশ্বাসযোগ্য আশ্রয়?
আজ বাস্তবতা কঠিন। অভিযোগ তুললে সুযোগ হারানোর ভয় থাকে, নীরব থাকলে মর্যাদা হারানোর যন্ত্রণা। দুই দিকেই ক্ষত, দুই দিকেই অন্ধকার। এখন সময় এসেছে —এমন সময়ে দরকার সাহসী উদ্যোগ। যেমন:
এসব শুধু প্রক্রিয়া নয়, নারী খেলোয়াড়দের জন্য প্রয়োজনীয় ঢাল। তারা যেন জানতে পারে—অভিযোগ করলে ক্যারিয়ার শেষ হয় না, বরং ন্যায়বিচারের দরজা খোলে। জাতি যখন তাদের হাতে ওঠানো স্বর্ণ নিয়ে গর্ব করে, তখন সেই স্বর্ণের আড়ালে থাকা ভয়, ক্লান্তি ও নীরবতার গল্পটিও শোনা উচিত। কারণ মাঠ যদি নিরাপদ না হয়, তবে কোনো পদকই পূর্ণ আলোয় জ্বলে না। নারীদের জন্য নিরাপদ মাঠ নিশ্চিত করতে পারলেই বাংলাদেশ সত্যিকারের ক্রীড়া শক্তিতে পরিণত হবে। আর সেই দিনের জন্যই তারা প্রতিদিন লড়ে যাচ্ছেন—মাঠে, মাঠের বাইরে, নীরবে এবং কখনো উচ্চকণ্ঠে।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন একটাই—খেলা কি শুধু প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে, নাকি এই সিস্টেমের বিরুদ্ধেও? উত্তর খুঁজে পাওয়া জরুরি, এখনই। কেননা নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে উন্নয়ন, অগ্রগতি বা বিজয় কোনোই অর্থ বহন করে না। মাঠকে নিরাপদ করা গেলে তবেই খেলাটা সত্যি খেলায় রূপ নেবে।
কারণ, যদি মাঠ নিরাপদ না হয়, তবে কোনো স্বর্ণই জাতির গৌরব নয়। নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে উন্নয়ন, অগ্রগতি বা বিজয় কোনোই অর্থ বহন করে না। মাঠকে নিরাপদ করা গেলে তবেই খেলাটা সত্যি খেলায় রূপ নেবে।
✍️ –অধ্যাপক ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা্ সম্পাদক, অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)
#বাংলাদেশ নারী ক্রীড়া, #যৌন হয়রানি, #জাহানারা আলম, #কামরুন্নাহার কলি, #নারী ফুটবল দল, #পিটার বাটলার অভিযোগ, #টেনিস ফেডারেশন, #ক্রীড়া সালিশি আদালত, #NCAS BD, #নারী নিরাপত্তা, #ক্রীড়াঙ্গনে ন্যায়বিচার