
এককালের খরস্রোতা পুনর্ভবা নদী এখন খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। জেলার সাপাহার উপজেলার সীমান্তবর্তী পুনর্ভবার বুকে একসময় চলতো পালতোলা নৌকা। নৌকাযোগে মানুষ বিভিন্ন হাটে-বাজরে গিয়ে তাদের উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী বিক্রি করতো। বিয়েসহ নানা গ্রামীণ উৎসবেও এই নদী মুখর ছিল। বাহারী বিয়ের নৌকার বহর নিয়ে এই নদী দিয়েই যাতায়াত করতো শৌখিন বরযাত্রী। এখন সেখানে বছরের বেশির ভাগ সময় পানি থাকে না। এটি এখন পায়ে চলা পথ।
সরেজমিনে দেখা যায়, পুনর্ভবার দুই তীরে সবুজ বনের হাতছানি থাকলেও নদীর বুকে খাঁ খাঁ বালু চর। নেই সবুজ ঘাসও। শিশু-কিশোররা দৌড়ঝাঁপ, ফুটবল ও ক্রিকেট খেলায় মেতে আছে। এটি যে এককালে নদী ছিল তা হয়ত তাদের মনেই থাকে না।
পুনর্ভবা নদী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। এটি বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের দিনাজপুর জেলা এবং পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ২২৩ কিলোমিটার ও গড় প্রস্থ ১০২ মিটার। পুনর্ভবা নদীর প্রাচীন উৎস ব্রাহ্মণপুর বরেন্দ্রভূমি। অতীতে নদীটি তীব্র খরস্রোতা ও সারা বছর প্রবহমান ছিল। তখনকার দিনে নদী পাড়ের মানুষ ওই নদীর পানি দিয়ে মাঠে হরেক রকম ফসল উৎপাদন করতো। আবার শুকনো মৌসুমে নদীর পানি কমে গেলে নদী তীরবর্তী মানুষ নদীর মাছ শিকার করে নিজেদের মাছের চাহিদা পূরণ করতো। কেউবা জীবিকা নির্বাহ করতো। কালের বিবর্তনে সব হারিয়েছে। বর্তমানে নদীটি দেখলে মনেই হবে না যে এটি একটি খরস্রোতা নদী। মনে হয় যেন বর্ষাকালে পানি নিষ্কাশনের একটি খাল।
এই পুনর্ভবা নদী উত্তরবঙ্গে প্রবাহিত একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী ছিল। দিনাজপুর শহর এই নদীর অববাহিকায় অবস্থিত। বর্তমানে মৃত ঘাঘরা, গাবুরা, কাঁচাই প্রভৃতি নদী এক সময় পুনর্ভবারই উপনদী ছিল। নদীর গতিপথ উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত। আত্রাই থেকে কয়েক কিলোমিটার পশ্চিমে পুনর্ভবার উচ্চতর গতিপথ। দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হওয়ার পর পুনর্ভবা ঢেপা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। যা করতোয়া নদীর একটি শাখা নদী। দিনাজপুর শহরের ঠিক দক্ষিণে নদীটি পশ্চিম এবং পশ্চিম-কেন্দ্রীয় বরেন্দ্রভূমির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এর নদী বিস্তৃত ভূমির প্রশস্ততা ৩ থেকে ৮ কিলোমিটার।
পুনর্ভবা নদীটি উজানে ভারত থেকে নেমে এসে সাপাহার উপজেলার উত্তর পাতাড়ী গ্রামের কাবলীরঘাট হয়ে বাংলাদেশের আন্তঃসীমানা নদী হয়ে কলমুডাঙ্গা, পোরশার নিতপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের রোকনপুর হয়ে মহানন্দা নদীর মোহনায় মিলিত হয়ে পদ্মা নদীতে পড়েছে।
নদী তীরবর্তী সাপাহার উপজেলার উত্তর পাতাড়ী গ্রামের প্রবীণ মতিউর রহমান, আব্দুল খালেক বিশ্বাস ও আব্দুল্লাহ পুনর্ভবার স্মৃতিচারণ করে বলেন, একসময় নদীটি সারা বছর প্রবহমান থাকতো। দেশের রাস্তাঘাটের উন্নয়ন না থাকায় সারা বছর এই নদীর বুকচিরে নৌকাযোগে মানুষ বিভিন্ন হাটে-বাজরে গিয়ে তাদের উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী বিক্রি করতো। এমন কি মাঝে মধ্যেই বাহারী বিয়ের নৌকার বহর চোখে পড়তো এই নদীতে।
নওগাঁর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদের সভাপতি এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সদস্য অ্যাডভোকেট ডিএম আব্দুল বারী বলেন, এককালের খরস্রোতা এই নদীটি এখন তার অতীত যৌবন, ঐতিহ্য, সৌন্দর্য, গৌরব সব হারিয়ে মরা খাল ও ছেলে মেয়েদের খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। নদীটি শুকিয়ে যাওয়ায় পার্শ্ববর্তী এলাকায় শুকনো মৌসুমে সেচের পানির অভাবে কৃষিকাজও ব্যাহত হচ্ছে।
তিনি বলেন, নদীটি পুনঃখনন করা হলে নদী তার পুরোনো যৌবন ফিরে পাবে। তীরবর্তী এলাকার কৃষি সেচের উৎস হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। নদী তীরের বাসিন্দারা হাজার হাজার হেক্টর জমিতে নদীর পানি দিয়ে সেচের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করতে পারবে। এতে একদিকে এলাকাবাসীর যেমন আয়ের পথ উন্মোচিত হবে, অন্যদিকে তা উত্তরাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখবে।
শিগগিরই পুনর্ভবা নদী খনন করে স্থানীয় মানুষের জীবন ও জীবিকার পথ উন্মোচন করতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে নওগাঁবাসী।
নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী প্রবীর কুমার পাল বাসসকে বলেন, পুনর্ভবা নদীটি দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চল হতে উৎপত্তি হয়েছে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা নদীতে পতিত হয়েছে। দেশের ৬৪টি জেলার ছোট নদী, খাল, জলাশয় পুনঃখনন প্রকল্পের আওতায় পুনর্ভবা নদী খননের প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদিত হলে ক্রমান্বয়ে পুনর্ভবা নদীও খনন করা হবে। নদীটি পুনঃখনন করা হলে শুষ্ক মৌসুমে ও প্রবহমান থাকবে।
বাবুল আখতার রানা
বাসস
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: