
এক সময় আলিয়া মাদ্রাসা ছিল বাংলাদেশে শিক্ষার আলোকবর্তিকা। আজ সে ধারা দাঁড়িয়ে আছে অবমূল্যায়ন, সামাজিক অবজ্ঞা এবং নীতিনির্ধারকদের উদাসীনতার ক্রসফায়ারে। ১৭৮০ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষার যুগপৎ সমন্বয়ে যে আধুনিক ধারার সূচনা করেছিল, আজ তা হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থ সংকটে জর্জরিত, প্রান্তিক এবং ভুলভাবে অনুধাবিত এক শিক্ষা ব্যবস্থা।
*হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য*
আলিয়া মাদ্রাসার ইতিহাস গৌরবময়। এই ধারা জন্ম দিয়েছে নবাব আব্দুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো জ্ঞানতাপস ও রাষ্ট্রনায়কদের। তবে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে এই ধারাটি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রীয় অবহেলা ও বিনিয়োগের অভাবে ধ্বংস হয়ে যায় সেই বিদ্যাবিন্যাসের ঐতিহ্য, যে ব্যবস্থাটি এক সময় জাতি গঠনের মূল কেন্দ্র ছিল।
ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গিয়ে আমি নিঃশব্দ হয়ে পড়েছিলাম। কোনো উত্তর খুঁজে পাইনি। একসময়ে যে আলিয়া মাদ্রাসা থেকে জন্ম নিয়েছিল বিজ্ঞানী, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, গবেষকের মতো বহু কৃতী মানুষ—আজ সেই ধারাটি যেন থেমে গেছে। এই শিক্ষা ধারার প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নবাব আবদুল লতিফ, খ্যাতিমান বিচারপতি ও লেখক সৈয়দ আমীর আলী, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক মোহাম্মদ আকরাম খান, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান। এছাড়াও রয়েছেন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান এবং খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা এবং বিচারপতি মাহবুব মুর্শেদ।
প্রশ্ন জাগে—গত অর্ধশতাব্দী ধরে কেন এই মাদ্রাসাগুলো আর তেমন কৃতি ব্যক্তিত্ব তৈরি করতে পারছে না? উত্তর একটাই—আমাদের অবহেলা, দীর্ঘদিনের পরিকল্পনাহীনতা এবং সদিচ্ছার অভাব।
পরিসংখ্যান বলছে সংকট প্রকট
২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট ৯,২৫৯টি পোস্ট-প্রাইমারি আলিয়া মাদ্রাসা রয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২৭.৫ লাখ। দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় এই শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ প্রায় ২০ শতাংশ হলেও ৯৯.৯৭ শতাংশ মাদ্রাসা বেসরকারিভাবে পরিচালিত হয়। ২৭০টি কামিল মাদ্রাসার মধ্যে মাত্র ৩টি সরকারি ব্যবস্থাপনায়।
শিক্ষক সংকট, ১:৪৫ পর্যন্ত ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত এবং জরাজীর্ণ অবকাঠামোতে ধুঁকছে এই ধারা। মাত্র ৩৬ শতাংশ মাদ্রাসায় রয়েছে বিজ্ঞান ল্যাব, আর মাত্র ২৭.৬৯ শতাংশ শিক্ষকের প্রশিক্ষণ রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের হার অত্যন্ত নগণ্য। দাখিল ও আলিম পর্যায়ে মেয়েদের সংখ্যা অর্ধেকেরও বেশি হলেও কামিলে তা নেমে আসে মাত্র ২২ শতাংশে।
*কাঠামোগত বৈষম্য*
_আলিয়া মাদ্রাসার সংকট শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, এটি মানসিক ও নীতিগত বৈষম্যেরও ফল:_
পাঠ্যক্রমের পক্ষপাত: অনেক ক্ষেত্রে পাঠ্যক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সমকালীন ইতিহাস বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। চিন্তাশীলতা তৈরির পরিবর্তে গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
**চাকরির বৈষম্য:* *সরকারি চাকরিতে আবেদন করতে গিয়ে আলিয়া শিক্ষার্থীরা পেশাগত স্বীকৃতি না পাওয়ার কারণে বঞ্চনার শিকার হন।
*শহর-গ্রাম বৈষম্য*: মাদ্রাসার ৮৫ শতাংশই গ্রামীণ এলাকায় অবস্থিত। ফলে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থেকে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত থাকে।
**বাজেট বৈষম্য: **শিক্ষা বাজেটের বড় একটি অংশ সাধারণ শিক্ষায় বরাদ্দ হলেও মাদ্রাসা শিক্ষায় বরাদ্দ থাকে অত্যন্ত অপ্রতুল।
*প্রশাসনিক অচলাবস্থা*: বারবার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও প্রাথমিক স্তরের ইবতেদায়ী মাদ্রাসা জাতীয়করণে কোনো অগ্রগতি হয়নি। শিক্ষক নিয়োগে পুরোনো এমপিও নীতিমালার জটিলতা কাটছে না। এমনকি ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার মতো মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানও স্থায়ী শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে।
*উত্তরণের পথ*: আলিয়া মাদ্রাসা ব্যবস্থার সংস্কার এখন সময়ের দাবি। এই মুহূর্তে বাস্তবায়নযোগ্য কিছু পদক্ষেপ হতে পারে:
জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে পূর্ণ একীভূতকরণ
প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সমতাভিত্তিক বিষয় স্বীকৃতি
প্রতিটি বিভাগে শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন
বিজ্ঞান ল্যাব, গ্রন্থাগার, কম্পিউটার ল্যাবের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি
ইসলামি চিন্তাবিদ ও আধুনিক শিক্ষাবিদের অংশগ্রহণে সিলেবাস সংস্কার
*উপসংহার*: আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি অবহেলা শুধু একটি নীতিগত ব্যর্থতাই নয়, এটি বাংলাদেশের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। সময়োপযোগী সংস্কার ছাড়া এই শিক্ষায়তনগুলো কেবল ধর্মীয় আদর্শ নয়, গোটা প্রজন্মের স্বপ্ন ধ্বংস করে ফেলবে। প্রশ্ন হলো—একটি জাতি তার এক-পঞ্চমাংশ শিক্ষার্থীর প্রতি এমন অবহেলা করে কিভাবে নিজেদের অগ্রসর দাবি করতে পারে?
এখন সময়, আলিয়া মাদ্রাসার ঐতিহ্যকে শুধুমাত্র স্মৃতিচারণে নয়, বাস্তবিক উন্নয়নে ফিরিয়ে আনার—সুযোগ, শ্রদ্ধা ও সুশাসনের মাধ্যমে।
- অধ্যাপক ড. মাহবুব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: