আমরা সবাই জানি স্পিলবার্গের প্রথম বিশ্ব কাঁপানো ফিল্মের নাম হলো Jaws, কিন্তু মজার ব্যাপার হলো উনি নিজে এই মুভির অভিজ্ঞতা বর্ননা করেছেন এভাবে “the worst experience of my life”! লিটারেলি ২৭ বছর বয়সি স্পিলবার্গের দুঃস্বপ্ন ছিল এই মুভির শ্যুটিং। সমস্যা শুরু মেইন ক্যারাক্টার নিয়ে, ২৫ ফুটি মেকানিক্যাল শার্ক, যার নাম ছিল “Bruce” । ভদ্রমহোদয়ের পারফর্ম্যান্স ছিল যাচ্ছেতাই, ৫৫ দিনের শ্যুটিং শেষ হলো ১৫৯ দিনে আর ৪.৫০ মিলিয়নের বাজেট দাঁড়ায় ১০ মিলিয়নে!

 

ষ্টিভেন স্পিলবার্গ ষ্টিভেন স্পিলবার্গ


স্বভাবতই প্রডাকশন টিম, ষ্টুডিও সবাই নাখোশ। স্পিলবার্গ পাগল প্রায়, শ্যুটিং কিভাবে শেষ করেন। বাধ্য হলেন ইম্প্রোভাইজ করতে। পানির নীচের শটের চেয়ে সার্ফেস-এবাভ ওয়াটার শটের দিকেই বেশি মনোযোগি হলেন তিনি। এবং মজার ব্যাপার হলো, এই সব সার্ফেস-এবাভ ওয়াটার শট সাথে ফোর-নোট হন্টিং মেলোডি মিলে এমন সাস্পেন্স মুভিতে তৈরি হলো যে সেটি রিলিজ হওয়ার পর সর্বকালের সেরা হিট মুভিতে স্থান নিয়েছে। বলা হয়ে থাকে, মুভিতে শার্ক দেখা থেকে ‘শার্ক না দেখা’ ছিল ভয়ংকর!

মুভি সুপার-ডুপার হিট, মিলিয়ন ডলার ইনকাম, এ সবের আড়ালে চাপা পরে গেল শিডিউলের চেয়ে ১০০ দিনেরও বেশি শ্যুটিং, বাজেটের আড়াই গুন ব্যয়। ফলাফল, স্পিলবার্গ কিছুই শিখলেন না, চলে গেলেন নেক্সট প্রজেক্টে।

এ জায়গায় আমার কিছু কথা বলি। আমার মতে বেশিরভাগ প্রতিভাবান লোক এই ভুল করে। মেধা আছে, একটু অগোছালো, প্রথম প্রথম লোকজন তাক লেগে যায়, ধরা দেয় সফলতা, আর এখানেই আরো বড় সমস্যার শুরু। আগের সমস্যাগুলোর সাথে যোগ হয় সফলতার স্বাদ। সাবধান না হলে সামলানো কঠিন। আশেপাশে এরকম অনেক উদাহরন আমিই দিতে পারি।

আশ্চর্যের ব্যাপার এর পরের মুভি Close Encounters of the Third Kind যেটিও ছিল বাজেট এবং শিডিউল নিয়ে একই সমস্যায় জর্জরিত বক্স অফিস হিট, পরে এই মুভি বানানোর অভিজ্ঞতাকে ভদ্রলোক ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে “twice as bad and twice as expensive”!

 

ষ্টিভেন স্পিলবার্গ ষ্টিভেন স্পিলবার্গ


যাই হোক, পর পর দুটি মুভির সফলতা সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিল একজন সফল মুভি মেকারের সাথে আর স্পিলবার্গকে বানালো বেপরোয়া। তিনি শুরু করলেন তার তৃতীয় প্রজেক্ট, 1941 যেটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযূদ্ধের উপর একটা স্যাটায়ার যেখানে পার্ল হার্বার বম্বিং এর পর জাপানিদের ভয়ে ভীত আমেরিকানদের উপহাস করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই আমেরিকানরা মুভিটাকে ভালভাবে নেয়নি এবং স্পিলবার্গ মুভি তৈরির শুরু থেকেই বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হতে হতে বুঝতে পারলেন কত ধানে কত চাল।


আগের দূর্নাম কাটানোর জন্যে স্পিলবার্গ মুভি শুরুর আগেই ঘোষনা দিয়েছিলেন যে ১২ মিলিয়ন ডলারের উপর এক পেনিও খরচ করবেন না যেটা ফিল্ম ইতিহাসের অন্যতম সেরা জোকে পরিনত হয় যখন মুভির বাজেট গিয়ে ঠেকে ৩১.৫ মিলিয়ন ডলারে! আরো আশ্চর্য হবেন জেনে যে, মুভিকে ঘিরে সবচেয়ে ছোট সমস্যা ছিল এটা। স্ক্রিপ্ট ছিল বাজে, ডিরেকশন ছিল যাচ্ছেতাই। এর সাথে যোগ করুন, লিড ক্যারাক্টারের সাথে ইগোতে জড়ানো, সহজ সফলতার আকন্ঠ অহমিকায় মোড়া প্রতিভাবান, খেয়ালি একজন অগোছালো পরিচালকের খেয়ালি আচরন।

ফলাফল হলো হাতে নাতে, স্বর্গ থেকে পতন। যে স্পিলবার্গ ছিলেন হিট মুভির আরেক নাম তার মুভি আমেরিকাতে প্রায় কেউ দেখলোই না। তারপরও 1941 কিছু প্রফিট করেছিলো পৃথিবীর অন্য প্রান্তের মানুষজন আমেরিকানদেরকে নিয়ে হাস্যরস পছন্দ করেছিল বলে। মুভিটা নিয়ে স্পিলবার্গ এতই লজ্জিত হয়ে পড়েন যে রিলিজের সময় উনি দেশেই ছিলেন না!

পুরো কাহিনীর আসল টুইষ্ট এর পর থেকে। স্পিলবার্গ কেন স্পিলবার্গ এর জবাব পাওয়া যাবে এর পর উনি কি করলেন তার মধ্যে খুজলে। সবাই ভুল করে, কিন্তু ভুল থেকে শিক্ষা নেয় কতজন? স্পিলবার্গ জানতেন তার প্রতিভাতে কোন সমস্যা নেই, সমস্যা হলো ডিসিপ্লিন। উনি ভাল মুভি বানাতে জানেন কিন্তু জানেন না কিভাবে বাজেটে থেকে, শিডিউল অনুযায়ী মুভি বানাতে হয়।

এরপর স্পিলবার্গ যা করলেন তা আমাদের সমাজের কন্টেক্সট এ সম্পূর্ন বিরল। উনি একজন গুরুর শরনাপন্ন হলেন যার নাম, জর্জ লুকাস। এই ভদ্রলোকও আরেকজন লিজেন্ড, স্পিলবার্গের পুরনো বন্ধু, সমসাময়িক ফিল্মমেকার কিন্তু গুরুত্বপূর্ন হলো লুকাস বাজেট এবং শিডিউলের জন্যে বিখ্যাত। দুজনের ফিল্ম-মেকিং ষ্টাইলের কন্ট্রাষ্ট বুঝাতে গিয়ে বলা হয়ে থাকে, একবার স্পিলবার্গের সেট দেখে লুকাসের অলমোষ্ট হার্ট এটাক হয়ে গেছিল।

যাই হোক, সবাইকে অবাক করে দিয়ে স্পিলবার্গ লুকাসের সহকারী হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হলেন এবং দুজন মিলে শুরু করলেন Indiana Jones and the Raiders of the Lost Ark বানানো। এটা স্পিলবার্গের জন্যে কতটা কার্যকরী হয়েছিল সেটা জানা গেল যখন ১৯৮১-র সবচেয়ে ব্যবসাসফল মুভি বানানো শেষ হয় মাত্র ৭৩ দিনে যখন শিডিউল ছিল ৮৫ দিনের!

মুভি শেষ হলো, ব্যবসা সফল হলো, কিন্তু স্পিলবার্গের লক্ষ্য এসব ছিল না। তার পাওয়া ছিল, দূর্বলতা কাটিয়ে উঠার রাস্তা খুজে পাওয়া যেটা স্পিলবার্গের সাথে সাথে সমগ্র পৃথিবীর জন্যেই গুরুত্বপূর্ন ছিল।
এখানে জর্জ লুকাসও ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। আমাদেরকে কেউ গুরু মানলে আমরা তাকে পেয়ে বসি। ভেঙ্গে চূরে নিজের মত গড়ে তোলার জন্য পাগল হয়ে যাই। লুকাস কিন্তু তা করেননি, উনি স্পিলবার্গের দূর্বলতাকে কাটিয়ে উঠতে হাতে-কলমে সাহায্য করেছেন, তার শক্তিমত্তায় পরিবর্তনের চেষ্টা করেন নি।