
একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞের দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য জাতিসংঘে যোগাযোগ করছে বাংলাদেশ।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, বাংলাদেশের এই দিবসটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে এর প্রেক্ষাপট ও তাৎপর্য তুলে ধরে বহির্বিশ্বে কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হবে।
জাতীয় সংসদের স্বীকৃতির পর ইতোমধ্যে একাত্তরের ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। প্রথমবারের মত এই দিবস পালনে সরকারের নেওয়া কর্মসূচি জানাতে বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আসেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী।
তিনি বলেন, “জাতিসংঘে ৯ ডিসেম্বর গণহত্যা দিবস পালিত হয়ে আসছে। যেদিন দিবসটি পালিত হয় এর পেছনে কোনো ইতিহাস নেই। এটা পরিবর্তন করে ২৫ মার্চে আনতে আমাদের যে যুক্তি সেগুলো তুলে ধরা হবে।”
‘দিবস পালন করতে হয় বলেই জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বরকে গণহত্যা দিবস হিসেবে ধার্য করেছে’ মন্তব্য করে মোজাম্মেল হক বলেন, “এটাকে ২৫ মার্চে পরিবর্তন করে আনার জন্য যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত দিয়ে আমরা ডকুমেন্ট তৈরি করেছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন দূতাবাসের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের কাছে তা পাঠাবে। পাশাপাশি মতবিনিময় করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”
জাতিসংঘের জেনোসাইড কনভেনশন গৃহীত হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর। এ কারণে ওই দিনটিকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয় ২০১৫ সালে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বলেন, ২৬ মার্চ বিজয় দিবস উদযাপন এবং প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর ‘পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়’ পূর্ণ উদ্যোমে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাবে; কেন ৯ ডিসেম্বর পরিবর্তন করে ২৫ মার্চ হওয়া উচিৎ।
“আমরা একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করি, ওইদিন বাংলাদেশে একটা ঘটনা ঘটেছিল, ভাষার জন্য মানুষকে হত্যা করেছিল, এটা একটা কারণ।
“আমরা বিশ্বাস করি, যেহেতু ৯ ডিসেম্বরের পক্ষে কোনো যুক্তি নেই। আমাদের যুক্তি হল, প্রায় ৫০ হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, এই ঢাকা শহরে। পৃথিবীর মধ্যে এক দিনে এত বেশি লোককে কখনও এভাবে হত্যা করা হয়নি।”
বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের শ্বাসরোধ করতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এ দেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের সেই অভিযানে কালরাতের প্রথম প্রহরে ঢাকায় চালানো হয় গণহত্যা।
এরপর নয় মাসের যুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং জাতির অসাধারণ ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।
সেই কালরাতের কথা স্মরণ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোতে হত্যা করেছে, ছাত্র-শিক্ষককে হত্যা করেছে, পিলখানায় বিডিআর, রাজারবাগে পুলিশ, কমলাপুর রেল স্টেশনে, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে, বিভিন্ন বস্তিতে ঘুমন্ত নারী, শিশু, বৃদ্ধকে হত্যা করেছে, বস্তিগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করেছে।”
বিশ্বযুদ্ধের সময় কিছু ‘নারকীয় ঘটনা’ ঘটলেও যুদ্ধ ঘোষণা না করে একই দেশের মানুষের ওপর পরিচালিত এরকম গণগত্যার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।
“একই রাষ্ট্রের নাগরিকদের এমনভাবে হত্যা করার কথা কল্পনাও করা যায় না। তাই আমরা মনে করি, আমাদের এই যুক্তি বিশ্ববাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।”
এখন কূটনৈতিক পর্যায়েও প্রেক্ষাপট বদলেছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, তখন যেসব রাষ্ট্র প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তাদেরও এখন ‘উপলব্ধি এসেছে’, একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত ‘ভুল ছিল’।
“কাজেই আমরা বিশ্বাস করি, আমরা কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সফলভাবে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের বোঝাতে সক্ষম হব, তাহলে ৯ ডিসেম্বরের পরিবর্তে ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের স্বীকৃতি পাওয়া আমাদের জন্য সহজ হবে।”
জাতিসংঘে প্রস্তাব পাঠাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবেদন তৈরি করেছেন জানিয়ে মোজাম্মেল বলেন, “এ মাসেই জাতিসংঘে পাঠানো হবে। কূটনীতিক জাতিসংঘে গিয়ে (প্রস্তাব জমা) দিয়ে আসবেন।”
আর বিভিন্ন দেশের সমর্থন আদায় সহজ করতে জাতিসংঘে প্রস্তাব ওঠানোর আগেই পুরোদমে কূটনৈতিক তৎপরতা চলবে বলে জানান তিনি।
গণহত্যা দিবস ঘোষণার বিষয়টি অনেক ‘দেরিতে হয়েছে’ স্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বলেন, “তবে একটা কথা আছে- বেটার লেট দেন নেভার।”
২৫ মার্চের ঘটনাপ্রবাহ সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত তুলে ধরেন মন্ত্রী। পাশাপাশি ২৫ মার্চের বর্বর হত্যাযজ্ঞকে যারা অস্বীকার করে আসছেন, তাদেরও সমালোচনা করেন।
গণহত্যা দিবসের কর্মসূচি
মন্ত্রী মোজাম্মেল বলেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে এবার ব্যাপক আকারে গণহত্যা দিবসের কর্মসূচি পালন সম্ভব না হলেও ইতিহাসে এ ঘটনা ‘মাইলফলক’ হয়ে থাকবে।
২৫ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ সংলগ্ন স্থানে ‘রক্তাক্ত ২৫ মার্চ: গণহত্যা ইতিবৃত্ত’ শিরোনামে আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও আলোচনা সভা এবং গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গীতিনাট্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে বলে জানান মোজাম্মেল।
এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা এবং গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নীতিনাট্য ও সাংস্কৃতি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা এসব অনুষ্ঠান বাস্তবায়ন করবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
বিদেশের দূতাবাসে এবার গণহত্যা দিবস পালন করা হচ্ছে না জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “দূতাবাসে এ ধরনের অনুষ্ঠান পালনের জন্য ন্যূনতম সাত দিন সময় লাগে, বিভিন্ন জনকে দাওয়াত দিতে হয়, সভা আয়োজন করতে হয়। তবে চেষ্টা করব আমাদের (দূতাবাসের) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে কর্মসূচি পালন করা যায় কি না…। ভবিষ্যতে অবশ্যই (দূতাবাসে) করব।”
এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, “ভবিষ্যতে যারা অন্যান্য জাতীয় দিবসের মত গণহত্যা দিবস পালন করবে না, তাদের বাংলার মানুষই চিহ্নিত করবে।”
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মাহমুদ রেজা খান ছাড়াও তথ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: