ঢাকা | সোমবার, ৯ জুন ২০২৫, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের আওতায় ১৮০ টি ঘড় নির্মান বগুড়ার শেরপুরে “জমি আছে ঘড় নেই” প্রকল্পে হরিলুট

Mahbubur Rohman Polash | প্রকাশিত: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ২০:৩৮

Mahbubur Rohman Polash
প্রকাশিত: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ২০:৩৮


আব্দুর রাহিম, শরপুর (বগুড়া):
যে সকল ব্যাক্তির জমি আছে ঘর নেই, এই সকল লোকদের মুখে হাসি
ফুটানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মহতী এক প্রকল্প গ্রহন করা
হয়। কিন্ত কিছু অসাধু ব্যাক্তির কারণে প্রধানমন্ত্রীর এই মহতী উদ্দ্যোগ
ভেস্তে যেতে বসেছে।
বগুড়ার শেরপুরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের আওতায় “জমি
আছে ঘড় নেই” প্রকল্পে নিয়মনীতি উপেক্ষা করে প্রকৃত
সুবিধাভোগীদের বঞ্চিত করে ও নিন্মমানের সামগ্রী দিয়ে ঘর তৈরী করে
দিয়ে বিপুল পরিমান অর্থলোপাটের অভিযোগ উঠেছে। একদিকে ঘর বরাদ্দের
নামে একটি চক্র মোটা অংকের টাকা অপরদিকে নির্মান সামগ্রী ক্রয়ের
নামে এই অর্থ লোপাটের সমস্ত ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছে। এই
তালিকায় ৭/৮ বিঘা জমি ও এখনো বাড়ি রয়েছে এমন ব্যাক্তিদের নামও
রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের
আওতায় শেরপুর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডে ২টি করে
মোট ১৮০টি ঘর নির্মানের কাজ শুরু হয়েছে। ১৫ ফুট প্রস্ত ও ১৬ ফুট
লম্বা প্রতিটি ঘর (অনেক ঘরের মাপ ঠিক নেই) ও টয়লেট নির্মান বাবদ ১ লক্ষ
টাকা (মোট ১কোটি ৮০লক্ষ টাকা, সরকারি ভ্যাট ও অন্যান্য খরচ বাদে) বরাদ্দ
দেয়া হয়েছে। কাজটি ২০১৭/১৮অর্থ বছরে শেষ করার কথা থাকলেও দেরিতে শুরু
হওয়ায় অর্থগুলো অন্য একটি এ্যাকাউন্টে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। সরাসরি
ক্রয় পদ্ধতির (ডিপিএম) মাধ্যমে মালামাল কিনে অর্থ বরাদ্দের তারিখ থেকে ৪৫
দিনের মধ্যে ঘড়গুলো নির্মান করার কথা। এ উপলক্ষে শেরপুর উপজেলায় ৫ সদস্য
বিশিষ্ট ক্রয় কমিটি করে বিভিন্ন মালামাল ক্রয় করার কথা কিন্ত কমিটির
বেশিরভাগ সদস্যই কিছুই জানেননা। যে মালামালগুলো ক্রয় করা হয়েছে তা
নি¤œমানের ও কম দামের, এতে এখানে বিপুল পরিমান অর্থলোপাটের চিত্র
ফুটে উঠেছে। প্রতিটি ঘর নির্মান বাবদ ১২ ফিট খুঁটি ১২টি ও ১০
ফিট খুঁটি ৯টি ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। ওই খুটির ভিতরে ৬ মিলির ৪টি
রড থাকার কথা থাকলেও সেখানেও অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এমনকি

খুঁটি তৈরীতে যে পরিমান সিমেন্ট ব্যবহার করার কথা তা ব্যবহার করা হয়নি
এবং ৩ নং ইটের খোয়া ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি ঘড়ে
৫৮০টি ১নং ইট ব্যবহার করার নিয়ম থাকলেও সেখানে ৪৫০টি থেকে ৫৫০টি
ইট ব্যবহার করা হয়েছে (কোথাও আবার সেটি ২নং ইট) বলে ভুক্তভোগীরা
জানিয়েছেন। ৩ ইঞ্চি ঢালাই দেয়ার কথা থাকলেও দেয়া হয়েছে দেড় থেকে ২
ইঞ্চি এবং খোয়ার সাথে বিপুল পরিমান ডাষ্ট ব্যবহার করা হয়েছে।
সিমেন্টের পরিমান দেয়া হয়ে খুব কম, যেখানে ১৪ ব্যাগ দেয়ার কথা
সেখানে দেয়া হয়েছে ৭ ব্যাগ। ঘরের চারপাশে ইট দিয়ে মেঝে তৈরী করতে
সিমেন্টের গাথুনি দেয়ার কথা থাকলেও নীচের ২ লাইন ইট শুধুমাত্র বালিদিয়ে
সাজিয়ে রেখে দেয়া হয়েছে, যা পরবর্তিতে পলিস্তারার মাধ্যমে ঢেকে দেয়া
হচ্ছে। তাছাড়া ঘরের খুটি ইট দিয়ে চতুর্দিকে বাউন্ডারী তৈরী করে তার
মধ্যে রাখার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। পাশাপাশি যে কাঠ দিয়ে ঘড়
নির্মান করার কথা, তা না দিয়ে কমদামের নি¤œমানের ও মাপে কম কাঠ
ব্যবহার করা হয়েছে। ২ ইঞ্চি বাই ২ ইঞ্চির নীচে কোন কাঠ ব্যবহার করা
যাবেনা কিন্ত সেখানে পৌনে ১ইঞ্চি বাই পৌনে ২ ইঞ্চি কাঠ ব্যবহার করা
হয়েছে। এবং মটকার নীচে রোয়া ও চালার চর্তুদিকে রোয়ার পরিবর্তে
বাটাম ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়াও দরজা একেবারেই নিন্মমানের,
চারদিকে বাটাম দিয়ে একটি শিট কোন রকমে আটকে দেয়া হয়েছে,
সেই সাথে জানালা হয়েছে দুর্বল। তাছাড়া প্রকল্প তৈরীর সময় যে ইষ্টিমেট
করা হয়েছে সেখানে মাটি কাটা, ঘরের মেঝে তৈরী ও মালামাল বহন বাবদ খরচ
রাখা হলেও এই সকল খরচ ঘর পাওয়া সুবিধাভোগী ব্যাক্তিদের নিকট থেকে
নেয়া হচ্ছে।অপরদিকে ঘড় তৈরীতে যে টিন ব্যবহার করা হয়েছে সেটি
নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন ভুক্তভোগীরা। সরেজমিনে গিয়ে বিভিন্ন ব্যাক্তিদের
সাথে কথা বলে জানা যায়, যে মানে ঘর তৈরী হচ্ছে তাতে সর্বোচ্চ ৫০
থেকে ৬০ টাকা ব্যয় হচ্ছে। কিন্ত এখানে বাজেট করা হয়েছে ১ লক্ষ টাকা
করে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিজেই কাজ
করছেন। যে সকল মালামাল ক্রয় করা হয়েছে তা তিনি একাই ক্রয় করেছেন,
কমিটির লোকজনকে দিয়ে পরবর্তিতে শুধুমাত্র সই স্বাক্ষর করে নিচ্ছেন।
একটি বিশ্বস্থসুত্রে জানা গেছে তিনি তার পরিচিত ব্যাক্তিকে দিয়ে
চট্রগ্রাম থেকে বরাদ্দের চেয়ে অনেক কমদামে টিন ক্রয় করেছেন।
অপরদিকে তালিকা তৈরীর সময়ও নিয়ম কানুন মানা হয়নি বলে অনেকেই
অভিযোগ করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী যার জমি আছে কিন্ত কোন ঘর নেই
এই প্রকল্পের মাধ্যমে শুধুমাত্র সেই ব্যাক্তিই ঘর পাবেন, কিন্ত অনেক ব্যাক্তির
জমি ঘর দুটোই থাকা সত্বেও তারাই আবার ঘর পেয়েছেন, এখানেও টাকা
বিনিময়ের অভিযোগ তুলেছেন অনেকেই। এমনকি ৭/৮ বিঘা জমির মালিকও
এই তালিকায় ঠাই পেয়েছেন।
মির্জাপুর ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের জাহাঙ্গীর আলমের বাড়ীতে গিয়ে
জানা যায়, সে পিতার একমাত্র পুত্র সন্তান, আরেকটি মেয়ে আছে বর্তমানে
অনার্সে পড়ছেন। তার পিতার আবাদি জমির পরিমান ৮ থেকে ১০ বিঘা,
রয়েছে বিশাল বাড়ী। এমনকি তার দাদা ও মায়ের নামেও রয়েছে বিপুল পরিমান

সম্পত্তি। যা সে ওয়ারিশ সুত্রে প্রাপ্ত হবেন। এছাড়াও ওই ওয়ার্ডের ফুলজানের
বাড়ীতে গিয়েও দেয়ালের বাড়ী দেখা গেছে। অপরদিকে ১নং ওয়ার্ডের তালতা
গ্রামের সিরাজুল ইসলামের রয়েছে তিন থেকে ৪ বিঘা জমি। এবং
মির্জাপুরের কানু মেম্বার তার ওয়ার্ডে তার আপন ভাতিজাকে ঘর
দিয়েছেন, অথচ সে ঘর পাবার উপযুক্ত ব্যাক্তি নয়। এ ব্যাপারে কানু মেম্বার
বলেন, আমার ঘর আমি যাকে খুশি দেব এখানে বলার কেউ নেই।
সরেজমিনে গেলে, এই প্রকল্পের ঘর প্রাপ্ত খানপুর ইউনিয়নের ভাটরা গ্রামের
রাজেক আলী ও মুকুল শেখ জানান, শুনেছিলাম এই ঘর করতে আমাদের কোন
টাকা ব্যায় হবেনা। কিন্ত কাজ শুরুর পর হতে দেখলাম মাটিকাটা, ঘরের মেঝে
তৈরী করা, ইট, কাঠ, টিন ও বাটাম সহ বিভিন্ন আসবাবপত্র বহন বাবদ ও
মিস্ত্রিদের বকশিস সহ আমাদের প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয়
হয়েছে। কোথাও কোথাও আবার তা ১০ হাজার টাকায় ঠেকেছে। তাছাড়া
সব সময় ঘড়প্রাপ্ত ব্যাক্তিদেরকে তাদের সাথে নিয়মিত কাজ করতে হত।
অপরদিকে মির্জাপুর ইউনিয়নের সাগরপুর গ্রামের সোনাতন সরকার
জানান, যারা কাজ করতে এসেছেন তারা আমাদের সাথে খারাপ আচরণ সহ
সকল মালামাল বহন করানো, ঘরের মাটিকাটা, মেঝে তৈরী করা সকল কাজ
আমাদেরকে দিয়ে করানোর ফলে আমাদের ৫/৬ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে।
গাড়িদহ ইউনিয়নের ঘর প্রাপ্ত মাসেদা বেগম জানান, ঘর তৈরী করার সময়
আমি অসুস্থ থাকায় আমার নিকট কোন টাকা ছিলনা। কিন্ত যারা ঘর তৈরী
করতে এসেছিল তাদের চাপে বাধ্য হয়ে সুদের উপর টাকা নিয়ে এসে ঘরের
মেঝেতে মাটি কাটা, আসবাবপত্র বহন ও বালি ক্রয় করেছি। এমনকি যারা
নিজেরা বালি কিনে না আনে তাদের ঘরে কোন রকমে মাটির উপরেই
ঢালাইয়ের কাজ করা হয়।
সাগরপুর গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী আন্দারু, কহিতকুলের বিলকিস বেগম সহ
একাধিক ব্যাক্তি জানান, যে মানের ঘর তৈরী করা হচ্ছে তাতে সর্বোচ্চ
৫০/৬০ টাকা ব্যয় হবে। কিন্ত শুনেছি এই ঘড় নির্মানে ১ লক্ষ টাকা ব্যয়
সত্যিই অবিশ্বাস্য।
জানা যায়, উপজেলা নির্বাহী অফিসার সিরাজুল ইসলাম, সিমাবাড়ী ও
বিশালপুর ইউনিয়নের ৩৬টি ঘর ওই ২ চেয়ারম্যানকে দিয়ে, বাকি ঘর গুলো
শেরপুরের জনৈক ফরহাদ নামের ব্যাক্তিকে দিয়ে চুক্তিভিত্তিক কাজ করে
নিচ্ছেন। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, চেয়ারম্যানদের ৮০
হাজার টাকা ও ফরহাদকে ৭০ হাজার টাকায় চুক্তি দিয়ে কাজ করে নিচ্ছেন
উপজেলা নির্বাহী অফিসার।
ফরহাদ হোসেন জানান, আমি কাজ করছি কিন্ত সব বিল উপজেলা নির্বাহী
অফিসার নিজে তুলছেন। কত টাকায় ঘর নির্মানে চুক্তি নিয়েছেন প্রশ্ন
করলে তিনি তা জানাতে অস্বীকার করেন।
বিশালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন জানান, ঘর তৈরী কিছু
ত্রæটি বিচ্যুতি রয়েছে, আপনারা বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি না করলেই আর
কিছু হবেনা। তাছাড়া তিনি আরও জানান, প্রতিটি ঘর তৈরীতে ৬/৭ বস্তা
সিমেন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে

খানপুর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য নুরুল ইসলাম নুরু জানান, উপজেলা
নির্বাহী অফিসার এই প্রকল্পের টাকা লুটপাট করছেন। যে ব্যাক্তিকে দিয়ে
কাজ করাচ্ছেন তিনি সব আসবাবপত্র নিন্মমানের ব্যবহার করছেন। এবং
ডিজাইনের বাইরে গিয়ে ঘর নির্মান করা হচ্ছে।
মির্জাপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি গোলাম নবী বাদশা জানান,
এই প্রকল্পে চেয়ারম্যান, মেম্বার ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মিলে হরিলুট
করে খাচ্ছে। তারা কোন রকমের নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা করছেন না। তালিকার
সময় টাকা আদায়, ঘর নির্মানের সময় কমদামের জিনিসপত্রের ব্যবহার ও
ইষ্টিমেটের বাইরে গিয়ে নামকাওয়াস্তে ঘর নির্মান করে বুঝিয়ে দেয়া
হচ্ছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সামছুন্নাহার শিউলী ওই
প্রকল্পের সদস্য সচীব জানান, সকল তথ্য উপজেলা নির্বাহী অফিসার
সিরাজুল ইসলাম সাহেবের নিকট রয়েছে আপনারা সেখানে যোগাযোগ
করুন। এ ব্যাপারে তিনিই ভাল বলতে পারবেন। তাছাড়া আমি সবেমাত্র
যোগদান করেছি, এর কিছুই জানিনা।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সিরাজুল ইসলাম বলেন, কাজের
ব্যাপারে খোঁজ নেয়া হচ্ছে, কোন ত্রæটি পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা
নেয়া হবে।
আব্দুর রাহিম
শেরপুর, বগুড়া।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: