—বিশেষ প্রতিবেদন
দৈনন্দিন জীবনে দুর্যোগ-সহনশীলতা অর্জন ও বিপদ থেকে আত্মরক্ষার জন্য ইসলামী শিক্ষা ও নির্দেশনা অপরিহার্য। এ প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে ঈমান, তাওয়াক্কুল, অপচয় বর্জন, যাকাত-সাদাকাহ, স্বাস্থ্য সচেতনতা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং বিপদে পাঠযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ দু'আসমূহ। মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত থাকার জন্য ইসলামী জীবনব্যবস্থা কীভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখে—তা তুলে ধরা হয়েছে সুস্পষ্টভাবে।
দৈনন্দিন জীবনে দুর্যোগ-সহনশীলতায় ইসলামী নির্দেশনা
দৈনন্দিন জীবনে ইসলামী নির্দেশনা মেনে চললে একজন মুমিন শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টিই অর্জন করে না, বরং এটি তাকে শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিকভাবে দুর্যোগ-সহনশীল (Disaster Resilient) করে তোলে। ইসলামের মূল শিক্ষাগুলোই আমাদের জীবনকে বিপর্যয়ের মুখে দৃঢ় রাখে।
১. ঈমানী দৃঢ়তা ও মানসিক সহনশীলতা
ভূমিকম্প বা মহামারির মতো দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানসিক শক্তি ও স্থিরতা। ইসলাম এই শক্তি সরবরাহ করে।
- তাকদীর ও তাওয়াক্কুল (আল্লাহর ফয়সালা ও ভরসা): মুমিন বিশ্বাস করে যে, তার জীবনে যা কিছু ঘটে, তা আল্লাহর পূর্ব নির্ধারিত ফয়সালা (তাকদীর) অনুযায়ীই ঘটে। এই বিশ্বাস তাকে চরম বিপদেও ধৈর্যশীল রাখে।রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: "আশ্চর্য মুমিনের ব্যাপার! তার সব কাজই তার জন্য কল্যাণকর হয়... যদি সে সুখে থাকে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে; আর যদি কষ্টে থাকে, ধৈর্য ধারণ করে— উভয়টিই তার জন্য কল্যাণকর।" (সহীহ মুসলিম)
- নিয়মিত ইবাদত ও দু'আ: নিয়মিত সালাত (নামাজ), সাওম (রোজা), ও দু'আ চর্চা মুমিনকে আল্লাহর সাথে যুক্ত রাখে। এই সম্পর্ক বিপদের সময় শান্ত ও স্থির থাকার আত্মিক শক্তি যোগায়। বিশেষ করে সকালে ও সন্ধ্যায় বিপদ থেকে সুরক্ষার দু'আগুলো পাঠ করা।
২. অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও সামাজিক প্রস্তুতি
ইসলামের আর্থিক নির্দেশনাগুলো ব্যক্তি ও সমাজকে অর্থনৈতিক বিপর্যয় মোকাবেলায় প্রস্তুত করে।
- অপচয় পরিহার ও সঞ্চয়: ইসলামে অপচয় (ইসরাফ) কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে কৃচ্ছ্রতা অবলম্বন ও নিয়মতান্ত্রিক সঞ্চয় (যা প্রয়োজন ছাড়া খরচ না করা) যেকোনো আকস্মিক আর্থিক দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- সাদাকাহ ও যাকাত প্রদান: নিয়মিত সাদাকাহ ও বাধ্যতামূলক যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সমাজে একটি নিরাপত্তা জাল তৈরি হয়। এই তহবিল দুর্যোগের সময় দরিদ্র ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে কাজে লাগে, যা সামাজিক ঝুঁকি কমায়।
- ঋণমুক্ত জীবন: ঋণগ্রস্ত হওয়াকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ঋণমুক্ত জীবন অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল সময়ে চাপমুক্ত থাকতে সাহায্য করে।
৩. শারীরিক স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত সতর্কতা
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হওয়া ইসলামী আদর্শের অংশ।
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা (তাহারাত): ইসলামে পরিচ্ছন্নতাকে ঈমানের অংশ বলা হয়েছে। দৈনন্দিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা (যেমন পাঁচ ওয়াক্ত অজুর মাধ্যমে হাত, মুখ ধোয়া) মহামারি ও রোগ প্রতিরোধের প্রথম ধাপ। এটি জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় সরাসরি অবদান রাখে।
- সুন্নত ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: অতিরিক্ত ভোজন পরিহার করে স্বাস্থ্যকর ও পরিমিত খাদ্য গ্রহণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। রাসূল (সা.) বলেছেন: "পেটের এক ভাগ খাদ্যের জন্য, এক ভাগ পানীয়ের জন্য এবং এক ভাগ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখা উচিত।" (সহীহ তিরমিজি)
- পরিবেশ সংরক্ষণ: গাছ লাগানো, নদী-নালা দূষণমুক্ত রাখা, এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা ইসলামের নির্দেশনা। পরিবেশগত বিপর্যয় (যেমন বন্যা, ভূমিক্ষয়) কমাতে এটি দীর্ঘমেয়াদি সহনশীলতা তৈরি করে।
৪. পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা
- জরুরি জ্ঞানার্জন: দুর্যোগপূর্ণ অঞ্চলে বসবাসকারী পরিবারগুলোর জন্য ইসলামী শিক্ষাই যথেষ্ট নয়, বরং ভূমিকম্প বা বন্যার মতো পরিস্থিতি মোকাবেলায় আধুনিক জ্ঞান ও কৌশল (যেমন ফাস্ট এইড, জরুরি যোগাযোগ) অর্জন করাও জরুরি।
- প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব: দুর্যোগে আক্রান্ত প্রতিবেশীর খোঁজ নেওয়া এবং সাধ্যমতো সহায়তা করা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
ইসলামী জীবনপদ্ধতি মানুষকে দায়িত্বশীল, মিতব্যয়ী, ধৈর্যশীল এবং সামাজিকভাবে সচেতন হতে শেখায়। এই গুণগুলোই একজন মুমিনকে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিতভাবে যেকোনো দুর্যোগ মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত করে তোলে। সহনশীলতা আসলে শুধু প্রস্তুতি নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলারই নাম।
বিপদ ও রোগ থেকে সুরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ দু'আসমূহ
এখানে দৈনন্দিন জীবনে পাঠ করার মতো কয়েকটি দু'আ দেওয়া হলো:
১. সাধারণ বিপদ-আপদ থেকে সুরক্ষার দু'আ
এই দু'আটি সকাল-সন্ধ্যা তিনবার করে পাঠ করার বিশেষ ফজিলত রয়েছে। যে কোনো আকস্মিক বিপদ থেকে আল্লাহ রক্ষা করেন।
بِسْمِ اللهِ الَّذِي لَا يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
- বাংলা উচ্চারণ: "বিসমিল্লাহিল লাযী লা ইয়াদুর্রু মা'আসমিহি শাইউন ফিল আরদি ওয়ালা ফিস সামা-ই, ওয়া হুয়াস সামী'উল 'আলীম।"
- অর্থ: "আল্লাহর নামে, যাঁর নামের সাথে আসমান ও যমিনের কোনো কিছুই ক্ষতি করতে পারে না। তিনি সর্বশ্রোতা, মহাজ্ঞানী।"
- ফজিলত: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি সকালে ও সন্ধ্যায় এই দু'আ তিনবার পাঠ করবে, কোনো কিছুই তার ক্ষতি করতে পারবে না।
২. মহামারি (প্লেগ/তাউন) ও কঠিন রোগ থেকে মুক্তির দু'আ
মহামারি বা মারাত্মক রোগ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার জন্য এই দু'আটি পড়া উত্তম।
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْبَرَصِ، وَالْجُنُونِ، وَالْجُذَامِ، وَمِنْ سَيِّئِ الْأَسْقَامِ
- বাংলা উচ্চারণ:"আল্লাহুম্মা ইন্নী আ'ঊযু বিকা মিনাল বারাসি, ওয়াল জুনূনি, ওয়াল জুযামি, ওয়া মিন সায়্যিইল আসক্বা-ম।"
- অর্থ: "হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে শ্বেত রোগ (বারাস), উন্মাদ রোগ (জুনুন), কুষ্ঠ রোগ (জুযাম) এবং সমস্ত খারাপ (মারণ) ব্যাধি থেকে আশ্রয় চাই।"
- ফজিলত: রাসূলুল্লাহ (সা.) এই কঠিন রোগগুলো থেকে আশ্রয় চাইতেন।
৩. অনিষ্টতা থেকে আশ্রয় চাওয়ার দু'আ (ঘর থেকে বের হওয়ার সময়)
ঘর বা বাসস্থান থেকে বের হওয়ার সময় এই দু'আটি পাঠ করলে শয়তানের অনিষ্টতা এবং অন্যান্য বিপদ থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়।
بِسْمِ اللهِ تَوَكَّلْتُ عَلَى اللهِ، لَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ
- বাংলা উচ্চারণ: "বিসমিল্লাহি, তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহি, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।"
- অর্থ: "আল্লাহর নামে, আমি আল্লাহর ওপর ভরসা করলাম। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া (পাপ কাজ থেকে বিরত থাকার বা সৎ কাজ করার) কোনো শক্তি বা ক্ষমতা নেই।"
- ফজিলত: এই দু'আ পাঠ করলে বলা হয়, 'তোমাকে যথেষ্ট দেওয়া হয়েছে, তুমি সুরক্ষিত এবং পথপ্রদর্শিত হয়েছ', এবং শয়তান তার থেকে দূরে সরে যায়।
৪. যেকোনো অপ্রত্যাশিত বিপদ দেখলে করণীয় দু'আ
কেউ যখন কোনো বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে দেখে, তখন তাকে নিয়ে বিদ্রূপ না করে বরং নিজের সুরক্ষার জন্য এই দু'আটি নীরবে পাঠ করা উচিত।
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي عَافَانِي مِمَّا ابْتَلَاكَ بِهِ، وَفَضَّلَنِي عَلَى كَثِيرٍ مِمَّنْ خَلَقَ تَف\ْضِيلًا
- বাংলা উচ্চারণ: "আলহামদু লিল্লাহিল্লাযী 'আ-ফা-নী মিম্মাবতালা-কা বিহী, ওয়া ফাদ্দালানী 'আলা কাছি-রিম্ মিম্মান খালাক্বা তাফদ্বী-লা।"
- অর্থ: "সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি তোমাকে যে বিপদে নিপতিত করেছেন তা থেকে আমাকে নিরাপদ রেখেছেন, এবং তাঁর সৃষ্টিকুলের অনেকের উপর আমাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।"
- ফজিলত: এই দু'আ পাঠ করলে সেই বিপদ বা রোগ তাকে স্পর্শ করবে না।
এই দু'আগুলো নিয়মিত পাঠ করলে মুমিন ব্যক্তি মানসিক শান্তি লাভ করে এবং এই বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে আল্লাহর ইচ্ছাই চূড়ান্ত।
মহান আল্লাহ!
আমাদের সবাইকে সকল প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে
হেফাজত করুন এবং নিরাপদ রাখুন।
আমিন।
✍️ –অধ্যাপক ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)
আগামীদিন পড়ুন: একজন মোমিনের জন্য সহজ ইসলামী রুটিন: দুর্যোগ-সহনশীল জীবনের জন্য।
#দুআ #ইসলামীজীবন #দুর্যোগসহনশীলতা #বিপদথেকেসুরক্ষা #তাওয়াক্কুল #দৈনন্দিনদুআ #ইসলামওস্বাস্থ্য #সাদাকাহ_যাকাত #পরিষ্কার_পরিচ্ছন্নতা #ইবাদত_ও_সুরক্ষা #ইসলামী_শিক্ষা #রোগপ্রতিরোধ