12/16/2025 ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস: অহংকারের পতন, বিনয়ের বিজয় ও আধুনিক নেতৃত্বের অঙ্গীকার এবং বিবেকের কণ্ঠস্বর
odhikarpatra
১৪ December ২০২৫ ১৫:১১
উপসম্পাদকীয়
১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ১৯৭১-এর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড, নিয়াজির অহংকারের পতন ও আধুনিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য বিনয়, জ্ঞান ও মানবিকতার অপরিহার্য অঙ্গীকার নিয়ে একটি গভীর বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ।
১৪ ডিসেম্বর: যখন নিয়তি হাসে, কিন্তু হৃদয় কাঁদে
আজ, ১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস—একাত্তরের সেই চূড়ান্ত পরাজয়ের মুহূর্তে, অহংকারী শক্তির শেষ আঘাতের স্মারক। এটি শুধু একটি দিন নয়; এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক নিদারুণ অধ্যায়, যা আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় যে অহংকার ইসলামে অগ্রহণযোগ্য, আর পরবর্তীতে কী হবে, তা শুধু সৃষ্টিকর্তাই বলতে পারেন।
১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় দোসরদের দ্বারা লক্ষ্যবস্তু হত্যার শিকার বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে জাতি আজ যথাযোগ্য মর্যাদায় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করছে। ইতিহাসের ফিরে তাকালে এই দিনটি ছিল বাঙালিদের জন্য দু:খজনক দিন।
নিয়তির দ্বারপ্রান্তে জেনারেলের দম্ভ: ১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। ঢাকায় তখন যুদ্ধজয়ের মিথ্যা ঘোষণা, আর হোটেলের সুইমিংপুলে বিমানবিধ্বংসী অস্ত্রের পরিত্যক্ত অবশেষ তোলার নিরর্থক চেষ্টা। জেনারেল নিয়াজি তখনো দম্ভ করছেন: "আত্মসমর্পণের প্রশ্নই ওঠে না।" তাঁর চোখে ছিল সেই কাঠামোগত অহংকারের ছায়া, যা সামরিক শক্তিকে নিয়তির ঊর্ধ্বে মনে করে। তিনি ভাবছিলেন, তাঁর পরিকল্পনায় ঢাকা রক্ষা হবে।
কিন্তু নিয়তি তখন হাসছিল। বাইরে শোনা যাচ্ছিল ভারতীয় কামানের আওয়াজ, আর ভিতরে বাঙালি রিকশাচালকটি নীরব অথচ অবিচল গতিতে প্যাডেল চালিয়ে যাচ্ছিল—নিয়তিকে তার অবশ্যম্ভাবী গন্তব্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে।
১৪ ডিসেম্বরের অন্ধকার—নিয়তি ও প্রতিশোধের মুখোমুখি: ১৪ ডিসেম্বর, নিয়তির গতি চরম পর্যায়ে পৌঁছাল। ঢাকা তখন মুক্ত হওয়ার দোরগোড়ায়। পাকিস্তানি বাহিনী বুঝতে পারল, সামরিকভাবে তাদের পরাজয় নিশ্চিত, এবং নিয়তির বিধানকে তারা এড়াতে পারেনি। ঠিক তখনই, সেই কাঠামোগত অহংকার চরম হতাশায় রূপান্তরিত হলো। এই হতাশা জন্ম দিল এক জঘন্য প্রতিশোধের স্পৃহা।
দখলদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা বেছে নিল অন্ধকারতম পথ। তারা শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, শিল্পী—অর্থাৎ জাতির বিবেক ও ভবিষ্যৎ স্থপতিদের ধরে নিয়ে গেল। এটি ছিল এক জঘন্যতম বার্তা: "আমরা থাকতে পারব না, কিন্তু তোমাদেরও মেরুদণ্ড থাকবে না।"
এটি কোনো সামরিক কৌশল ছিল না; এটি ছিল সেই পরাজিত অহংকারের শেষ বিষাক্ত নিঃশ্বাস, যা একটি নতুন জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি চিরতরে পঙ্গু করে দিতে চেয়েছিল। এই হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করল যে অহংকারী শক্তি যখন বুঝতে পারে তাদের ক্ষমতা শেষ, তখন তারা চরম অমানবিক হয়ে ওঠে।
নিয়তি হাসে, জাতি কাঁদে: ১৬ ডিসেম্বর নিয়াজি আত্মসমর্পণ দলিলে সই করলেন। নিয়তি তাঁর অহংকারকে ধূলিসাৎ করল। কিন্তু সেই বিজয়ের আবহে, বাঙালি জাতি আবিষ্কার করল এক গভীর ক্ষত। রায়েরবাজার ও অন্যান্য বধ্যভূমিতে যখন নিথর দেহগুলো পাওয়া গেল, তখন জাতি বুঝতে পারল—মুক্তি এসেছে ঠিকই, কিন্তু এর দাম দিতে হয়েছে দেশের সবচেয়ে আলোকিত মানুষদের জীবন দিয়ে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের যে দুটি গভীর সত্যের পথ দেখায়
১৪ ডিসেম্বর তাই শুধু একটি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস নয়;
এটি দুটি গভীর সত্যের প্রতীক:
১. অহংকারের অবশ্যম্ভাবী পতন: নিয়াজির মতো অহংকারী নেতাদের পতন অবশ্যম্ভাবী।
২. বিনয়ের শ্রেষ্ঠত্ব: বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন বিনয়ী, জ্ঞান তাপস। তাদের জ্ঞান এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রতি তাদের নিষ্ঠা ছিল অহংকারী শক্তির কাছে সবচেয়ে বড় হুমকি।
আজ, আমরা সেই শহীদদের স্মরণ করি—যারা তাদের বিনয়ী জ্ঞান ও প্রতিভার মাধ্যমে জাতিকে পথ দেখাতে চেয়েছিলেন। তাদের রক্ত আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, যেকোনো নতুন রাষ্ট্র বা নেতৃত্বকে অবশ্যই অহংকার ত্যাগ করে বিনয়, জ্ঞান ও মানবিকতার পথে চলতে হবে। একমাত্র সেই পথেই একটি জাতি সৃষ্টিকর্তার রহমত লাভ করতে পারে এবং অবশ্যম্ভাবী নিয়তির সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের এই স্মরণ আমাদের আধুনিক রাজনৈতিক নেতৃত্বে কী ধরনের বিনয়ী অঙ্গীকারের জন্ম দিতে পারে?
আধুনিক নেতৃত্বের বিনয়ী অঙ্গীকার
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের মর্মন্তুদ স্মৃতি থেকে শিক্ষা নিয়ে, আধুনিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিম্নলিখিত বিনয়ী অঙ্গীকারগুলি গ্রহণ করতে পারে, যা নিয়াজির অহংকারী কাঠামোর ঠিক বিপরীত হবে:
১. জ্ঞান ও যুক্তির প্রতি বিনয়ী অঙ্গীকার
২. ক্ষমতার বিনয়ী ব্যবহার ও জবাবদিহিতার অঙ্গীকার
৩. নিয়তির অবশ্যম্ভাবিতা স্মরণের অঙ্গীকার
এই বিনয়ী অঙ্গীকারগুলি গ্রহণ করলে, আধুনিক নেতৃত্ব নিশ্চিত করবে যে ১৯৭১ সালের সেই অহংকারী কাঠামোর পুনরাবৃত্তি যেন কোনোভাবেই না ঘটে এবং বাংলাদেশ যেন শহীদদের স্বপ্ন অনুযায়ী জ্ঞান, যুক্তি ও মানবিকতার পথে অগ্রসর হতে পারে।
ক্ষমতার সিংহাসন এবং বিবেকের কণ্ঠস্বর: একটি চিরন্তন দ্বৈরথ
এখন দেখি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের প্রেক্ষাপটে তৈরি এই বিনয়ী অঙ্গীকারগুলি আধুনিক রাজনীতির জন্য কতটা বাস্তবসম্মত। আসুন, এই প্রশ্নটিকে আমরা একটি গল্পের আঙ্গিকে দেখি।
রাজপথ, রাজদণ্ড এবং রাজমিস্ত্রির হাত
এক দেশে ছিল দুটি পথ—একটি ছিল রাজপথ, যা অহংকারের লাল গালিচায় মোড়া। এই পথে হাঁটতেন জেনারেল নিয়াজির মতো মানুষেরা, যাদের হাতে ছিল রাজদণ্ড। তারা নিজেদের সর্বশক্তিমান ভাবতেন, নিজেদের পরিকল্পনাকেই নিয়তির একমাত্র সত্য মনে করতেন। তাদের মুখে ছিল দম্ভের ঘোষণা: "আত্মসমর্পণের প্রশ্নই ওঠে না" কারণ তারা বিশ্বাস করতেন তাদের সামরিক শক্তিই শেষ কথা।
কিন্তু এই দেশের সমান্তরালে ছিল আরও একটি পথ—তা ছিল বিবেকের গলি, যেখানে হাঁটতেন বিনয়ী মানুষেরা। তাদের হাতে ছিল না রাজদণ্ড; ছিল শুধু কলম, বোর্ড বা ছুরি—অর্থাৎ রাজমিস্ত্রির সরঞ্জাম, যা দিয়ে তারা একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। এরা ছিলেন অধ্যাপক, চিকিৎসক, সাংবাদিক—আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা। তাদের শক্তি ছিল জ্ঞান এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রতি বিনয়ী নিষ্ঠা।
যখন অহংকারের চূড়া সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাল, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, রাজদণ্ড হাতে থাকা শক্তিটি শেষবারের মতো রাজমিস্ত্রিদের আঘাত হানল। তাদের মনে হয়েছিল, বিবেকের এই কণ্ঠস্বর থামিয়ে দিলেই তাদের মিথ্যা জয়ের দম্ভ টিকে থাকবে।
নিয়তির নির্মাণ: ভাঙা রাজদণ্ড থেকে নতুন ভিত্তি
কিন্তু নিয়তি (সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা) ছিল আরও বড় কারিগর।নিয়াজির রাজদণ্ড ভেঙে চুরমার হলো ১৬ ডিসেম্বর। রাজপথ শূন্য হলো, আর দেশের সামনে পড়ে রইল ভাঙা ইটের স্তূপ এবং বধ্যভূমির গভীর ক্ষত।
আধুনিক রাজনীতির চ্যালেঞ্জ হলো এই ধ্বংসস্তূপের ওপর নতুন করে নির্মাণ করা। প্রশ্ন হলো: আমরা কি আবার অহংকারের রাজদণ্ড দিয়ে নির্মাণ করব, নাকি বিনয়ের রাজমিস্ত্রির সরঞ্জাম দিয়ে?
বাস্তবতার দ্বন্দ্ব: আদর্শ বনাম ক্ষমতা
বাস্তবতা স্বীকার করে: হ্যাঁ, এই অঙ্গীকারগুলি বাস্তবসম্মত হলেও তা অনুসরণ করা কঠিন।
তবুও কেন এই অঙ্গীকার বাস্তব?
এই অঙ্গীকারগুলি বাস্তবসম্মত, কারণ:
পরিশেষে বলা যায়, আধুনিক নেতাকে প্রতিদিন সকালে উঠে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—তিনি কি নিয়াজির ভাঙা রাজদণ্ড ধরে ক্ষমতার দম্ভ দেখাবেন, নাকি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ফেলে যাওয়া কলম হাতে নিয়ে বিনয়ের সঙ্গে জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবেন। এই অঙ্গীকারগুলি তাই কেবল নৈতিক আদর্শ নয়, বরং একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য বাস্তব ভিত্তি।
- অধ্যাপক ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)
#১৪ডিসেম্বর #শহীদবুদ্ধিজীবীদিবস #Bangladesh1971 #IntellectualMartyrs #LiberationWar #বুদ্ধিজীবীহত্যাকাণ্ড #Genocide1971 #নিয়াজি #অহংকারওবিনয় #LeadershipEthics #বাংলাদেশেরইতিহাস #PoliticalHumility #HumanValues #WarCrimes1971 #NationAndConscience