12/16/2025 বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বর্তমান অস্থিরতা--- ইতিহাস, সময়তত্ত্ব, রাষ্ট্রচিন্তা ও জাতিগত চেতনার এক সমন্বিত পাঠ
Dr Mahbub
১৬ December ২০২৫ ০৫:৪১
--- বিশেষ সম্পাদকীয়
🖋️ স্বাধীনতার অমূল্য ঋণ | একটি জাতিসত্তার শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো তার স্বাধীনতা। আমাদের এই স্বাধীনতা তো আরো মহিমাময়, কারণ তা রক্তের দামে কেনা! এই ১৬ই ডিসেম্বর হলো বিগত তিন শতকের (২৬৮ বছরের) পথচলায় সবচেয়ে আনন্দময় দিন। কারণ, সেদিনই হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতার সূর্য পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে পুনরায় উদিত হয়েছিল। সেদিনই মানুষ মুক্ত বাতাসের বুকভরা শ্বাস নিতে পেরেছিল।
ইতিহাস কেবল ঘটনা নয়, একটি কাঠামো
ইতিহাসকে যদি কেবল তারিখ ও ঘটনার সমষ্টি হিসেবে দেখা হয়, তবে পলাশী, ১৯৪৭ কিংবা ১৯৭১—সবই বিচ্ছিন্ন অধ্যায় বলে মনে হবে। কিন্তু ইতিহাসতত্ত্ব (Historiography) আমাদের শেখায়, ইতিহাস আসলে একটি গঠনমূলক কাঠামোগত প্রক্রিয়া (structural process)—যেখানে ক্ষমতা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও মানসিকতা একসঙ্গে কাজ করে।
পলাশী: অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও কলোনিয়াল তত্ত্ব
পলাশীর যুদ্ধকে উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্ব (Postcolonial Theory) অনুযায়ী বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটি ছিল একটি “Internal Collapse before External Conquest”। ফ্রান্ৎস ফ্যানন ও এডওয়ার্ড সাইদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, উপনিবেশবাদ কেবল সামরিক শক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় না; এটি প্রতিষ্ঠিত হয়—স্থানীয় এলিটদের সহায়তায়,অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসঘাতকতায় এবং ক্ষমতার লোভ ও বিভক্ত আনুগত্যের মাধ্যমে। তাই বলা যায় মীর জাফর এখানে কোনো একক ব্যক্তি নন; তিনি একটি “Collaborative Class”-এর প্রতীক। এই শ্রেণি নিজেদের স্বল্পমেয়াদি স্বার্থে দীর্ঘমেয়াদি সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দেয়। ফলে পলাশী একটি যুদ্ধের চেয়ে বেশি—এটি একটি রাষ্ট্র ব্যর্থতার (State Failure) সূচনাবিন্দু।
সময়ের দীর্ঘ অন্ধকার: ২১৪ বছর ও কাঠামোগত শোষণ
২৩ জুন ১৭৫৭ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১—২১৪ বছর ৫ মাস ২৩ দিন—এই সময়কে মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থনীতির আলোকে দেখলে এটি ছিল একটি Extraction Regime। এই সময়ের বৈশিষ্ট্য ছিল: সম্পদের ধারাবাহিক বহিঃপ্রবাহ, স্থানীয় উৎপাদন কাঠামোর ধ্বংস, এবং মানসিক দাসত্ব (Mental Colonization)। এটি কেবল অর্থনৈতিক নয়, ছিল সাংস্কৃতিক ও মানসিক উপনিবেশ। আন্তোনিও গ্রামশির ভাষায়, এটি ছিল Cultural Hegemony—যেখানে শাসিত জনগোষ্ঠী ধীরে ধীরে শাসকের যুক্তিকেই স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়।
১৯৪৭: অসম্পূর্ণ স্বাধীনতা ও অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ
১৯৪৭-এর স্বাধীনতাকে অনেক তাত্ত্বিক “Transfer of Power” বলেন, “Transfer of Freedom” নয়। পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অংশ হলেও সেখানে শুরু হয় Internal Colonialism—যেখানে এক অংশ অন্য অংশকে শোষণ করে। রাষ্ট্রতত্ত্ব অনুযায়ী, একটি রাষ্ট্র তখনই স্থিতিশীল হয় যখন— ‘রাজনৈতিক ক্ষমতা, অর্থনৈতিক সম্পদ, এবং সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি’ সমভাবে বণ্টিত হয়। আর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এই তিনটিরই ঘাটতি ছিল। ফলে রাষ্ট্রটি কাঠামোগতভাবে ভেঙে পড়ার দিকে অগ্রসর হয়।
রমনা রেসকোর্স: জাতিগত ঐক্য ও নেশন-বিল্ডিং তত্ত্ব
রমনা রেসকোর্সকে যদি নেশন-বিল্ডিং তত্ত্ব (Nation-building Theory) দিয়ে দেখা হয়, তবে এটি ছিল একটি Collective Consciousness Formation Site। বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের ভাষায়, জাতি হলো একটি “Imagined Community”।
৭ মার্চ ১৯৭১-এ এই কল্পিত সম্প্রদায় বাস্তবে রূপ নেয়। এখানে তিনটি ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। যথা ভাষা → পরিচয়; স্মৃতি → শক্তি; ঐক্য → রাষ্ট্রের ভিত্তি। অর্থ্যাৎ ভাষার উপর আঘাত এখানে একটি জাতিগত পরিচিতি বা আইডেন্টিটিকে শক্তিশালী করে তোলে। বয়ে চলা শাসকের অত্যাচার ও শোষণের স্মৃতি গণ মানুষের মুক্তির সংগ্রামে শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
অন্যায় ও রাষ্ট্রীয় জুলুমের বিরুদ্ধে গণ মানুষের ঐক্য (কিছু মানুষ ব্যতীত) বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়ে দেয়। আর এ কারণেই মাত্র মাত্র ২৬৬ দিনে একটি সুপ্রশিক্ষিত আধুনিক মরণাস্ত্রে সজ্জিত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে একটি জাতি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের রূপ নিতে পেরেছে। এটি ইতিহাসের সবচেয়ে ঘনীভূত সময়-পর্বগুলোর একটি।
সংখ্যা তত্ত্ব ও সময়তত্ত্ব: প্রতীকী বিশ্লেষণ
সংখ্যা তত্ত্ব বা সময়তত্ত্ব (Temporal Theory) অনুযায়ী সময় কখনো নিরপেক্ষ নয়। ২১৪ বছর বনাম ২৬৬ দিন—এই তুলনা আমাদের দেখায়: বিভাজনের ফল দীর্ঘমেয়াদি ক্ষয় এবং ঐক্যের ফল দ্রুত রূপান্তর। আসলে এটি সমাজতাত্ত্বিকভাবে Critical Juncture Theory-এর উদাহরণ—কিছু সময় এমন হয়, যখন সিদ্ধান্ত ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়।
চন্দ্র–নক্ষত্র ও কালেক্টিভ সাইকোলজি
চন্দ্র–নক্ষত্রের প্রতীকী পাঠকে যদি আধুনিক ভাষায় অনুবাদ করা হয়, তবে এটি মূলত Collective Psychology বা জাতিগত মনস্তত্ত্ব। এটা নৃতাত্ত্বিকভাবে প্রমানিত যে, বাংলা একটি আবেগ প্রধান সমাজ। এখানে মানুষের আবেগ দুই ভিন্ন বিপরীতমুখী পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। যেমন আবেগ → দ্রুত ঐক্য এবং আবেগ → দ্রুত বিভাজন। অর্থ্যাৎ কখনো কখনো আবেগ ঐক্যের সৃষ্টি করে, যার শক্তি হয় অসীম, এবং অজেয়। আবার এই আবেগই মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরি করে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে। হিংসা ও বিদ্বেষের রাজ্য তৈরি করে। তাহলে কি দাঁড়ায়? এই দ্বৈত বৈশিষ্ট্যই বাংলার শক্তি ও দূর্বলতা। সামাজিক সংহতি (Social Cohesion) বজায় থাকলে এটি বিপ্লব ঘটায়, না থাকলে রাষ্ট্রকে অস্থির করে তোলে।
[একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সাহসিকতার উপাখ্যান জানতে দেখুন “Unsung Heroes Untold Stories of Liberation War of Bangladesh / পর্ব -৩ :বীরমুক্তিযোদ্ধা শফিউদ্দিন আহমেদ”]
আজকের বাংলাদেশ: রাষ্ট্রীয় অস্থিরতা ও নব-উপনিবেশবাদ
আজকের বাংলাদেশকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এখানে সরাসরি উপনিবেশ নেই, কিন্তু আছে Neo-Colonial Pressures। আর এই নব্য উপনিবেশবাদ মূলত তৈরি হয় অর্থনৈতিক কারণে। প্রথমত আমাদের শাসক গোষ্ঠীর সীমাহীন দূর্ণীতির কারণে অতি ঋণনির্ভরতা, দ্বিতীয়ত ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবের প্রতিক্রিয়া যথাযথ ভাবে দেখাতে না পারা তথা শাসন ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র পরিচালনায় অদক্ষতা, এবং তৃতীয়ত হচ্ছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আর তা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভাজন, যা পূর্বের উপনিবেশিক শাসকদের নতুন করে হস্তক্ষেপ করে নব্য উপনিবেশবাদ বিস্তারে ভূমিকা রাখে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুযায়ী, এটি একটি Fragile Democracy Scenario, যেখানে অভ্যন্তরীণ ঐক্য ভেঙে পড়লে বাহ্যিক শক্তি প্রভাব বিস্তার সহজে করতে পারে।
বৃহস্পতি উপাখ্যান ও ইতিহাসের শেষ আহ্বান
ইতিহাসের এক অদ্ভুত খেয়ালের নাম ‘বৃহস্পতিবার’। দেবগুরু বৃহস্পতির এই বারটি বাংলার ভাগ্যাকাশে কখনো এনেছে অমাবস্যার অন্ধকার, আবার কখনো এনেছে পূর্ণিমার জোছনা। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুনের পলাশী ছিল বৃহস্পতিবার; ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের ভগ্ন স্বাধীনতা ছিল বৃহস্পতিবার; আবার ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ও ছিল বৃহস্পতিবার।এই বার-এর পুনরাবৃত্তি কি শুধুই কাকতালীয়? নাকি এর ভেতরে লুকিয়ে আছে কোনো গূঢ় সংকেত?
বর্তমানেও গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান ইঙ্গিত দিচ্ছে—আমরা আবারও এক ‘সংবেদনশীল সন্ধিক্ষণে’ দাঁড়িয়ে। চন্দ্রের অস্থিরতা বলছে, জাতি হিসেবে আমরা আবারও আবেগের বশবর্তী হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার দ্বারপ্রান্তে। আরেকটি কালো বৃহষ্পতিবারের আগমনের সম্ভাবনা বাড়ছে। আবারো সামনে পড়ে থাকা কিছু সংখ্যা, কিছু দিনপঞ্জিকা এবং নক্ষত্রের অবস্থান আজ এক অদ্ভুত আয়নার সামনে এ জাতিকে দাঁড় করিয়েছে। আসুন, সেই আয়নায় একবার নিজেদের মুখটা দেখি।বিভেদের হেজিমনি থেকে ঐক্যের কলহতানে মুখরিত হই।
আজকের অস্থির সময়ে দাঁড়িয়ে, যখন অদৃশ্য সুতোর টানে আমরা পুতুলের মতো নাচছি, তখন সেই পুরোনো সতর্কবাণীটিই কানে বাজে—সাধু সাবধান। ভুল থেকে শিক্ষা না নিলে, সময় তার প্রতিশোধ নেবেই।আর সেই প্রতিশোধ ২১৪ বছরের গোলামির চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে। আমাদের ক্যালেন্ডারের পাতায় যেন আর কোনো ‘কালো বৃহস্পতিবার’ ফিরে না আসে, তার দায়িত্ব এখন এই ৫৪ বছর বয়সী বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের।
আর যদি কোন কাল্-বৃহস্পতিকে স্বগত জানাতে আমরা না চাই, তাহলে করণীয় কী? খুব সহজ। সোজা কথা—এক থাকলে আমরা বাঘ, আর আলাদা হলে আমরা শুধুই পণ্য। সিদ্ধান্ত আপনার—ইতিহাসের পাতায় বীর হয়ে থাকবেন, নাকি আবারও কোনো এক বৃহস্পতিবারের দীর্ঘশ্বাসে হারিয়ে যাবেন?
অপরদিকে ইতিহাস কি কেবল সাল-তারিখের শুকনো পাতা? নাকি মহাকালের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে থাকা এক জীবন্ত সত্তা, যে অলক্ষ্যে আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে? যখন আমরা পুরোনো ভুলগুলো নতুন করে করি, তখন ইতিহাস হয়তো ফিসফিস করে বলে—"তোমরা শিখলে না।"
তাই বলি, ভাইসব, সময় এসেছে জেগে ওঠার। আবেগে গা না ভাসিয়ে এবার একটু মাথাটা খাটান। নক্ষত্র বলছে সময়টা ভালো যাচ্ছে না, কিন্তু আমাদের ইচ্ছাশক্তি যদি শক্ত থাকে, তাহলে কোনো নক্ষত্রই আমাদের দমাতে পারবে না।
সময় কিন্তু চলে যাচ্ছে। একটু ভেবে দেখবেন! সময় গেলে কিন্তু সাধন হবে না।
চূড়ান্ত প্রতিফলন: ইতিহাসের শেষ পাঠ
পলাশী ও রমনা—এই দুই স্থান আসলে দুটি তত্ত্বের নাম। যথা: পলাশী = বিভাজনের রাষ্ট্রতত্ত্ব এবং রমনা = ঐক্যের রাষ্ট্রতত্ত্ব। এর মানে দাড়চ্ছে সেই ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে মীরজাফরদের বিশ্বাসঘাতকতা এক বিভাজনের রাজনীতির সূচনা করে। আর এই বিভাজনই আমাদের দীর্ঘ প্রায় ৭৮,৩৩৭ দিন পরাধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ করে শোষণের শিকলে বন্ধী করে রাখে। অপরদিকে রমানার রেসকোর্সের সেই অগ্নিঝরা ভাষণ আবার সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে, যা সার্বিকভাবে আমাদেরকে পরাধীনতার নাগহপাশ ছিন্ন করতে উদ্বুদ্ধ করে।
এখানে সার্বিক পর্যালোচনায় তথা ইতিহাস, সংখ্যা, জ্যোতিষ কিংবা তত্ত্ব—সব মিলিয়ে একটাই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়: রাষ্ট্র টিকে থাকে অস্ত্রে নয়, চেতনায়। চেতনা ভাঙলে রাষ্ট্র ভাঙে।
ইতিহাস আমাদের ভয় দেখায় না, ভবিষ্যৎ বলে দেয় না।
সে শুধু অতীতের আয়নায় বর্তমানকে দেখায়।
আর সেই আয়নায় ভেসে ওঠে একটাই বাক্য—
সাধু সাবধান।
- অধ্যাপক ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)
#মুক্তিযুদ্ধ #বিজয়দিবস #বাংলাদেশ #একাত্তর #১৬ডিসেম্বর #স্বাধীনতারস্বপ্ন #জাতীয়আদর্শ