05/06/2025 সাবেক পিয়ন চার হাজার কোটি টাকার মালিক!
Mahbubur Rohman Polash
২৪ জানুয়ারী ২০১৯ ১৮:২৩
স্টাফ রিপোর্টার
চার বছরে আমানত দ্বিগুণ করে দেওয়ার কথা বলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বাগেরহাট ডিসি (জেলা প্রশাসক) অফিসের সাবেক পিয়ন (এমএলএসএস) আবদুল মান্নান তালুকদারের বিরুদ্ধে।
এই টাকায় তিনি গড়ে তুলেছেন বেশ কয়েকটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। তবে তার দুর্নীতি আর প্রতারণার বিষয়ে তদন্ত শুরু হলে পরিবারসহ দীর্ঘদিন গাঢাকা দিয়েছিলেন তিনি। তবে আজ (২৪ জানুয়ারি) তাকে বাগেরহাটের ব্যবসায়িক অফিসে দেখা গেছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তদন্ত প্রতিবেদনে আবদুল মান্নানের পিয়ন থেকে কোটিপতি হওয়ার তথ্য উঠে আসে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট নামে কোম্পানি খুলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অবৈধভাবে আমানত সংগ্রহ করেন আবদুল মান্নান। তার সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানটি শুধু উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়েই নয়, মানুষকে আকৃষ্ট করতে ইসলামি শরিয়া মোতাবেক পরিচালিত ব্যাংকিংয়ের মতো লভ্যাংশ দেওয়ারও প্রস্তাব করে।
গ্রাহকরা জানান, চার বছরে অর্থ দ্বিগুণ হবে বলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতেন আবদুল মান্নান। তার মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ করেছেন।
এছাড়া আবদুল মান্নানের মালিকানাধীন নিউ বসুন্ধরা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি নামের আরেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ মিলেছে। তদন্তের পর অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে এ দুটিসহ মান্নানের মালিকানাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস বিভাগের উদ্যোগে শিগগিরই এ তদন্ত শুরু হবে।
এদিকে মান্নানের দুটি প্রতিষ্ঠানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তের পর দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাগেরহাট জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নেজারত শাখার সাবেক উমেদার (এমএলএসএস) আবদুল মান্নান তালুকদার দীর্ঘ ২৬ বছর চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী থেকে ২০১০ সালে স্বেচ্ছায় অবসরে যান। অবসর গ্রহণের পরেই বিত্তবৈভবে ফুলেফেঁপে ওঠেন তিনি। বর্তমানে তিনি চার হাজার কোটি টাকার মালিক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের খুলনা অফিস পরিচালিত তদন্ত বলছে, গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির মালিক নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে সম্পদ সৃষ্টি করেছেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আবদুল মান্নান তালুকদার মানুষের কাছ থেকে অবৈধভাবে ২৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত দল। এরমধ্যে আবদুল মান্নান নিজের নামে শুধু জমিই কিনেছেন ১৪৫ কোটি ২৩ লাখ টাকার। এছাড়া ৬৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন তার মালিকানাধীন ছয়টি প্রতিষ্ঠানে। প্রায় ২ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে এই পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে খুলনা, নড়াইল, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা ও যশোর জেলার বিভিন্ন এলাকার সাধারণ লোকদের কাছ থেকে এই আমানত সংগ্রহ করা হয়।
মান্নানের মালিকানাধীন নিউ বসুন্ধরা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতিও একই কায়দায় গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে। এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত দল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের খুলনা অফিস তদন্ত করেছে। এরপরই প্রতিষ্ঠানটির অবৈধ কার্যক্রমের বিষয়ে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবগত করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক ওই প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে জনগণকে সতর্ক করে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। আবদুল মান্নান তালুকদারের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে এখন আরও গভীর অনুসন্ধান চলছে।
আবদুল মান্নানের নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট এবং নিউ বসুন্ধরা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনও তদন্তে নেমেছে। প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিস অ্যান্ড ফার্মস (আরজেএসসি) ও সমবায় অধিদফতরকে চিঠিও পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকেও অবগত করে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ (২০০৩ পর্যন্ত সংশোধিত)-এর ৩১(১) ধারা মোতাবেক কোনও কোম্পানি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ব্যতীত জনগণের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করতে পারবে না। কিন্তু নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট নামক প্রতিষ্ঠানটি ৩১(১) ধারার নির্দেশনা লঙ্ঘন করে জনগণের কাছ থেকে উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে আমানত সংগ্রহ করছে। এছাড়া কোম্পানির মেমোরেন্ডাম অ্যান্ড আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশনের শর্তানুযায়ী, শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি তা না করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকেই আমানত সংগ্রহ করছে। যা ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১-এর ধারা ৩১(১)-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আর্থিক খাতে ডেসটিনি, ইউনিপে-টু ও যুবকের মতো বিপর্যয় সৃষ্টির এবং দেশের আরও বিপুলসংখ্যক গ্রাহকের আমানত ঝুঁকিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে উল্লেখ করা হয়, জনগণের কাছ থেকে আমানতের টাকা সংগ্রহ করে আবদুল মান্নান নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে সম্পদ সৃষ্টি করছেন; যা গুরুতর অনিয়ম এবং এতে গ্রাহকের আমানতের নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকিও প্রবল। এছাড়া সাবিল গ্রুপের সহযোগী ছয়টি প্রতিষ্ঠানে ৬৬ কোটি টাকা বিনিয়োগও বিধিবহির্ভূত। তাই সংগৃহীত আমানতের মাধ্যমে ক্রয়কৃত সম্পত্তির মালিকানা এবং সাবিল গ্রুপের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের বিষয়াবলি বিস্তারিত তদন্ত করা হলে আরও অনেক তথ্য উদ্ঘাটিত হবে।
তদন্ত দল বলেছে, প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক কার্যক্রম স্বচ্ছতা না থাকায় আমানতকারীদের প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক কার্যক্রম ব্যাপকভাবে তদন্ত হওয়া আবশ্যক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের খুলনা শাখার কর্মকর্তারা জানান, দুর্নীতি দমন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালানোর পর আবদুল মান্নান তালুকদার পরিবারসহ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. ইস্কান্দার মিয়া বলেন, আবদুল মান্নান তালুকদারের প্রতিষ্ঠানটি বৈধ কোনও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়। অথচ উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে তারা আমানত সংগ্রহ করেছে। সেই টাকা দিয়ে নিজের নামে সম্পত্তি করেছে। এখন তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই বলছে সে নাকি দেশ ছেড়ে পালিয়েছে।