odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Monday, 15th December 2025, ১৫th December ২০২৫
একটি অত্যাচারী গোষ্ঠী ও এক জেনারেলের দাম্ভিকতা, এক শহরের নিঃশব্দতা, এবং নিয়তির অবশ্যম্ভাবী বিজয়ের দিনপঞ্জি

অহংকার ও নিয়তির লীলা: ১৯৭১-এর ঢাকায় এক দিনের প্রতিচ্ছবি – ১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১

odhikarpatra | প্রকাশিত: ১২ December ২০২৫ ২৩:৫৯

odhikarpatra
প্রকাশিত: ১২ December ২০২৫ ২৩:৫৯

✍️বিশেষ ফিচার:

১৯৭১ সালের ১৩–১৬ ডিসেম্বর ঢাকার শহরে কীভাবে এক অহংকারী সামরিক শক্তি ধ্বংস হলো এবং কীভাবে পিটার আর কানের দিনপঞ্জি এই পতনের প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়াল, সেই গল্পই এই প্রবন্ধে ধরা হয়েছে। ইসলামী ভাবনা, ঐতিহাসিক ঘটনা ও মানবিক বার্তার এক অনন্য সংমিশ্রণ।

প্রথম দৃশ্য: পত্রিকার শিরোনাম বনাম বাস্তবতা

১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর, ঢাকার আকাশে ধোঁয়াশা, আর বাতাসে বারুদের গন্ধ। পিটার আর কান হোটেলের ছাদে দাঁড়িয়ে দেখলেন পত্রিকার শিরোনাম—“শত্রুর অগ্রগতি থেমে গেছে”। কিন্তু পুলের পানিতে ডুবে থাকা বিমানবিধ্বংসী অস্ত্রের টুকরো তুলে আনছিল কর্মীরা—যুদ্ধ থামেনি, কেবল দম্ভের মুখোশ পড়ে আছে। এই দৃশ্য ছিল এক অদ্ভুত প্রতীক: সত্যকে আড়াল করার একটি মরিয়া চেষ্টা, আর বাস্তবতার অনিবার্য জয়।

অহংকারের দুর্গে দাঁড়ানো জেনারেল

হোটেলের সামনের রাস্তায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি। সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন—“যেভাবে আমি পরিকল্পনা করেছি, সেভাবেই যুদ্ধ চলছে।” আরও স্পষ্ট করে বললেন: “আত্মসমর্পণের প্রশ্নই ওঠে না। সেনাবাহিনী মরে যাবে। প্রত্যাবাসনের জন্য কেউ থাকবে না।” এই উক্তি ছিল শুধু এক ব্যক্তির দাম্ভিকতা নয়, বরং একটি কাঠামোগত শ্রেষ্ঠত্ববোধের প্রকাশ। এক গর্বিত সামরিক শক্তি, যাদের বিশ্বাস ছিল—তাদের পরাজয় অসম্ভব।

নিকটবর্তী পরাজয় নিয়তির নীরবতা

জেনারেলের বক্তব্যের কয়েক গজ দূরে, বিহারিদের এক দল “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” বলে চিৎকার করছিল। তারা নাচছিল, চিৎকার করছিল, কান্না করছিল—একসাথে সবকিছু। রিকশার পেছনে বসা বিহারির উন্মাদনার বিপরীতে ছিল এক মাথা নিচু করে প্যাডেল চালানো বাঙালি রিকশাচালক। তার চোখে ছিল নীরবতা, কিন্তু পায়ে ছিল নিশ্চল গতি। পিটার লিখেছেন—এই দুই চরিত্রই যেন 'অহংকার বনাম নিয়তির' শ্রেষ্ঠ উপমা:

  • বিহারিদের উন্মত্ততা = দম্ভের ক্ষণস্থায়ী চিৎকার
  • রিকশাচালকের নীরবতা = নিয়তির ধীর, কিন্তু অবশ্যম্ভাবী যাত্রা

১৬ ডিসেম্বর:নিয়তির আঘাত, অহংকারের পতন

মাত্র তিন দিন পর, সেই একই জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিলে সই করলেন। তাঁর বলিষ্ঠ ঘোষণা—"আত্মসমর্পণের প্রশ্নই ওঠে না"—বিলীন হলো। নিয়তির অদৃশ্য হাত এসে গুঁড়িয়ে দিল অহংকারের সেই দুর্গ। রেডক্রস হোটেলকে নিরপেক্ষ এলাকা ঘোষণা করল, অস্ত্র তল্লাশি চলল, সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকেও অস্ত্র উদ্ধার হলো। গর্বের গড়া সামরিক কাঠামো যেন ভিতরে ভিতরে পচে গিয়েছিল।

ইসলামী দৃষ্টিকোণ: কিবর বনাম তাওয়াক্কুল

ইসলামে ‘কিবর’ অর্থাৎ অহংকারকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হাদীস বলছে— “যে ব্যক্তি তার অন্তরে এক কণার পরিমাণ অহংকার ধারণ করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” — সহীহ মুসলিম নিয়াজির দম্ভ ও তার তিন দিনের ব্যবধানে পতন যেন এই হাদীসের জীবন্ত উদাহরণ। মানুষ যখন নিজেকে ‘নিয়তির নিয়ন্ত্রক’ ভাবে, তখন সে আল্লাহর গুণাবলিকে আত্মসাৎ করতে চায়। আর তখনই ঘটে পতন। এটি ঠিক যেন গ্রিক পুরাণের ইকারুস—যিনি সূর্যের কাছে উড়ে গিয়ে ডানা হারিয়েছিলেন।

অহংকারের স্তর: ব্যক্তিগত নয়, কাঠামোগতও

নিয়াজির দম্ভ শুধুমাত্র তাঁর নয়, এটি ছিল একটি সামরিক, আদর্শিক ও জাতিগত কাঠামোর প্রতিফলন। এই কাঠামো:

  • সামরিক শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী ছিল
  • ধর্মীয় আবরণে নিজেদের অজেয় ভাবত
  • সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার ছিল

বিহারিদের চিৎকার এবং বাঙালিদের নীরবতা—এই দ্বৈত বাস্তবতা বোঝায়, কীভাবে সেই কাঠামো সামাজিক বিভাজনেরও জন্ম দিয়েছিল।

নতুন রাষ্ট্রের জন্ম: দম্ভ ভেঙে বিনয়ের শিক্ষা

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় কেবল এক পরাজয়ের চিত্র ছিল না, বরং নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ এক মহান শিক্ষার প্রতিফলন:

  • গণতন্ত্র > সামরিক একনায়কতন্ত্র
  • মানবিকতা > জাতিগত দম্ভ
  • আইনের শাসন > অস্ত্রের ভাষা

নতুন রাষ্ট্র তখন শিখেছিল—বিজয়কে বিনয়ে রূপ দিতে হয়, যেন তা অহংকারে রূপ না নেয়। বিজয়ের উল্লাসকে সীমিত রেখে, নতুন নেতৃত্ব চেষ্টা করেছিল আইনের শাসন, মানবিক ন্যায় এবং জাতিগত সমতা প্রতিষ্ঠায়।

শেষ কথা: নিয়তি সর্বেসর্বা, অহংকার ধ্বংসপ্রবণ

১৯৭১ সালের ঢাকার দিনপঞ্জি আমাদের শেখায়:

  • মানুষের পরিকল্পনা ক্ষণস্থায়ী
  • অহংকার চিৎকার করে, কিন্তু টিকে না
  • নিয়তি নীরব, কিন্তু অপ্রতিরোধ্য
  • সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা চূড়ান্ত—আর তার বিপরীতে দাঁড়ালে পতন অবশ্যম্ভাবী

নিয়াজির দম্ভ, বিহারিদের উল্লাস, রিকশাচালকের নীরবতা এবং আত্মসমর্পণের দলিল—এই প্রতিটি মুহূর্ত ছিল এক বৃহৎ পাঠ্যপুস্তকের পৃষ্ঠা, যেখানে লেখা ছিল একটাই কথা: "যার হৃদয়ে অহংকার, সে শেষপর্যন্ত পরাজিত। যে বিনয় নিয়ে এগোয়, সে হয় সফল সম্মানিত।"

📌 পাঠকদের প্রতি বার্তা: এই ইতিহাস যেন শুধু বিজয় উদযাপনেই সীমিত না থাকে। এটি হোক আত্মসমীক্ষার উপলক্ষ—আমরা কি এখনও সেই অহংকারে ভুগছি? না কি আমরা নিয়তির পথে বিনয় নিয়ে হাঁটছি?

আপনার মতামত দিনআমরা কি ১৯৭১-এর সেই বিনয়ের শিক্ষা আজও অনুসরণ করছি? ✍️ মন্তব্য করুন নিচে কমেন্টের বক্সে…

📣 এই ফিচার প্রবন্ধটি শেয়ার করুন এবং ছড়িয়ে দিন ইতিহাসের নৈতিক শিক্ষাঅহংকার নয়, প্রয়োজন বিনয়

অধ্যাপক মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)

#১৯৭১ #ঢাকা #জেনারেল_নিয়াজি #অহংকার_ও_নিয়তি #মুক্তিযুদ্ধ #পিটার_আর_কান #ইসলাম_ও_অহংকার #নিয়তির_অবশ্যম্ভাবিতা #বাংলাদেশ_বিজয় #আত্মসমর্পণ #IslamicEthics #HistoricalDhaka #Victory1971



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: