ঢাকা | সোমবার, ৫ মে ২০২৫, ২২ বৈশাখ ১৪৩২
আমেরিকার নারী পুরুষেরা সচরাচার যেমনটি করে থাকে আমি তার বিপরীতটি করেছি। আমি এ সম্পর্কে চিন্তিত ছিলাম

নারীবাদী লেখকের ইসলাম গ্রহন

Mahbubur Rohman Polash | প্রকাশিত: ২৫ মার্চ ২০১৮ ০৫:২৬

Mahbubur Rohman Polash
প্রকাশিত: ২৫ মার্চ ২০১৮ ০৫:২৬

থেরেসা করবিন লেখিকা।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিন্সে বসবাস করেন। তিনি ইসলামউইচ ডটকমের প্রতিষ্ঠাতা এবং অন-ইসলাম ডটকম ও অ্যাকিলা স্টাইল ডটকমের সহযোগী।

থেরেসা করবিন ছিলেন ক্যাথলিক। ২১ বছর বয়সের থেরেসা পরিবারের সাথে লুইসিয়ানার বাটন রুজে বাস করতেন। ইসলাম ধর্ম নিয়ে চার বছর গবেষণা করে ৯/১১-এর দুই মাস পর, ২০০১ সালের নভেম্বরে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। সময়টা ছিল খুব কঠিন। কিভাবে তিনি ইসলাম ধর্মে প্রবেশ করলেন সে প্রশ্নের জবাবে থেরেসা করবিন বলেন, ১৫ বছর বয়স থেকে ইসলামের প্রতি আমার প্রবল আগ্রহ জন্মে। আমার ক্যাথলিক ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে আমার মনে অনেক প্রশ্ন ছিল। আমার শিক্ষক ও যাজকদের এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তাদের কাছ থেকে উত্তর আসে, তোমার এই সুন্দর ছোট্ট মাথায় এ সম্পর্কে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। এই উত্তর আমাকে কখনই সন্তুষ্ট করতে পারেনি।

আমেরিকার নারী পুরুষেরা সচরাচার যেমনটি করে থাকে আমি তার বিপরীতটি করেছি। আমি এ সম্পর্কে চিন্তিত ছিলাম। বহু বছর ধরে আমার মনে ধর্মের প্রকৃতি, মানুষ এবং মহাবিশ্ব নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন জন্মাতে থাকে।

এ সবকিছু নিয়ে গবেষণার পর আমি সত্যকে খুঁজে পাই। ধর্মীয় অলঙ্করণ, ইতিহাস ও বিভিন্ন মতবাদ ইত্যাদির চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইসলাম নামের এই অসাধারণ জিনিসটি খুঁজে পাই।
আমি এটা শিখেছি যে, ইসলাম একটি সংস্কৃতি কিংবা ধর্মীয় প্রার্থনার প্রথা নয়। এটি শুধুমাত্র বিশ্বের একটি অংশেরও প্রতিনিধিত্ব করে না। আমি বুঝতে পেরেছি যে ইসলামই হচ্ছে একটি বিশ্বধর্ম যা মানুষকে সহনশীলতা, ন্যায়বিচার ও সম্মান করতে শেখায় এবং ধৈর্যধারণ, বিনয়ী এবং ভারসাম্যকে উৎসাহিত করে।

আমি আমার বিশ্বাস নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছি। আমি এটি দেখে বিস্মিত হয়েছি আমার পাশে অনেক লোক আমার সঙ্গে অনুরণিত হচ্ছে। আমি এটি খুঁজে পেয়ে সন্তুষ্ট ছিলাম যা ইসলাম তার অনুসারীদের শেখায় ।

ইসলাম মূসা থেকে যিশু, যিশু থেকে হজরত মোহাম্মদ (সা.) সমস্ত নবীকে সম্মান করতে শিক্ষা দেয়। এরা সবাই মানবজাতিকে এক আল্লাহর উপাসনা করতে শিক্ষা দিয়েছেন। তারা একটি মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের সঙ্গে আচরণ করতেন।
ইসলামের দিকে আমাকে আকৃষ্ট করেছে নবী মোহাম্মদের (সা.) উৎসাহব্যঞ্জক একটি উদ্ধৃতি, ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরজ বা বাধ্যতামূলক, হোক সে পুরুষ কিংবা নারী।’

আমি বিস্ময়ে আভিভূত হই যে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের উৎপত্তি হয়েছে মুসলিম চিন্তাবিদদের হাতে। আল-খাওয়ারিজমির বীজগণিত আবিষ্কার, লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির বহু আগেই ইবনে ফারনাসের ফ্লাইট বলবিজ্ঞানের উন্নতি সাধন ও আবু আল-কাসিম আল-জাহরি যাকে বলা হয় আধুনিক সার্জারি জনক।
২০০১ সালে আমাকে কিছু দিনের জন্য আমার পরিকল্পনা স্থগিত রাখতে হয়েছিল। আমি ভয়ে ছিলাম মানুষ খারাপ কিছু মনে করে কিনা। এটি ছিল আমার জন্য দুর্বিষহ। ৯/১১-এর অপহরণকারীদের কর্ম আমাকে আতঙ্কিত করে তোলে।

কিন্তু তার পর মুহূর্ত থেকে আমি আমার অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেছি মুসলমান এবং তাদের ধর্মকে রক্ষার জন্য। কিছু মুসলমানের খারাপ পদক্ষেপের কারণে ১.৬ বিলিয়ন মানুষের একটি গ্রুপ তৈরি হয়েছে যারা সবাই অত্যন্ত আগ্রহী ইসলামকে সমূলে উৎখাত করতে। আমি সেই লোকদের হাত থেকে ইসলামকে রক্ষার জন্য চেষ্টা করেছি।

অন্যদের মতামতের কারণে আমি লক্ষ্যপানে ছুটতে পারছিলাম না। ইসলামকে রক্ষার জন্য আমি আমার সমস্ত ভয়কে জয় করেছি ।আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার ভাই ও বোনদের সেই বিশ্বাসে নিয়ে যেতে যেটি আমি বিশ্বাস করি।

আমার পরিবার বুঝতে পারেনি কিন্তু আমার ধর্ম নিয়ে গবেষণা করাটা তাদের কাছে মোটেও আশ্চর্যজনক ছিল না। তারা আমার নিরাপত্তার নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। সৌভাগ্য যে আমার বন্ধুদের অধিকাংশই ইসলাম সম্পর্কে আগ্রহী ছিল , এমনকি এ সম্পর্কে আরও বেশি জানতে চাই ।
বর্তমান দিনগুলোতে হিজাব পরিধান করে আমি অত্যন্ত গর্বিত। আপনি এটিকে স্কার্ফ বলতে পারেন। আমার স্কার্ফ আমার হাত বেঁধে রাখে না এবং এটি জুলুম, নির্যাতনের কোনো হাতিয়ারও নয়। এটি আমার চিন্তাধারায় প্রবেশ করতে কোনো বাধা প্রদান করে না।

ইসলামকে নিয়ে গবেষণা করায় আমার সব সাংস্কৃতিক ভ্রান্ত ধারণা তাৎক্ষণিকভাবে দূরীভূত হয়নি। আমাকে প্রাচ্যের নারীর কল্পচিত্র আঁকতে হয়েছে। আমার ধারণা ছিল প্রাচ্যের পুরুষেরা নারীকে অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করে থাকে এবং পুরুষ কর্তৃক তাদের বাধ্য করা হয় তাদের শরীরকে ঢেকে রাখার জন্য ।

কিন্তু যখন আমি একজন মুসলিম নারীকে জিজ্ঞেস করি, ‘কেন আপনি হিজাব পরেন?’, জবাব আসে ‘আল্লাহকে খুশি করার জন্য। হিজাব পরিধানের মাধ্যমে একজন নারী হিসেবে আমাদেরকে সম্মানিত করা হয়েছে এবং পুরুষের হয়রানির শিকার থেকে এটি আমাদের নিরাপদ রাখে। পুরুষের খারাপ দৃষ্টি থেকে আমার নিজেকে রক্ষা করার জন্য এটি খুবই কার্যকর।’ তার উত্তর ছিল সুস্পষ্ট এবং অনুভূতিকে নাড়িয়ে দেয়ার মতো।

আশ্চর্যজনকভাবে ইসলাম এমন একটি ধর্ম যা আমার দীর্ঘদিনের নারীবাদী আদর্শের সাথে মিলে গেছে।”
তিনি শালীন পোশাককে বিশ্বের প্রতীক হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, একজন নারীর শরীর শুধুমাত্র উপভোগের জন্য অথবা সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লিখার জন্য নয়।

শালীন পোশাক কেমন করে বিশ্বের প্রতীক? প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দেন, ‘হ্যাঁ, আপনার বিশ্বাসে নারীদেরকে কি এখনও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মতো আচরণ করা হয় না?’
ধৈর্যশীল এই মুসলিম ভদ্র মহিলা ব্যাখ্যা করেন যে একটি সময় ছিল যখন পশ্চিমা বিশ্বে নারীদেরকে বিবেচনা করা হতো পুরুষের ভোগদখলের সম্পত্তি হিসাবে। কিন্তু ইসলাম শিক্ষা দেয়, আল্লাহর চোখে নারী-পুরুষ সবাই সমান।

ইসলামে বিবাহের ক্ষেত্রে নারীর সম্মতিকে মর্যাদা দেয় এবং নারীদেরকে উত্তরাধিকারী হওয়ার, নিজস্ব সম্পত্তি অর্জন, ব্যবসা পরিচালনা করা এবং সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছে।
তিনি বলেন, আজ থেকে বহু বছর পূর্বে ইসলাম নারীদের যে অধিকার প্রদান করেছে সেটি পশ্চিমারা কখন কল্পনাও করতে পারেনি।

 

বিবাহিত জীবন
আমাকে পারিবারিকভাবেই বিয়ে করতে হয়েছে। কিন্তু তাই বলে এটা ভাবার কোনো সুযোগ নেই যে আমাকে বাবা-মায়ের প্রথম পছন্দের পাত্রের সঙ্গে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়েছিল। আলাদিনের জেসমিনের মতো আমাকে বিয়েতে বাধ্য করা হয়নি। আমার বাবা আমার পছন্দকে না করেনি, এমনকি একটি কথাও বলেনি।

আমি যখন ধর্মান্তরিত হই তখন সময়টি মুসলিম হওয়ার জন্য মোটেও ভালো সময় ছিল না। আমি সারাক্ষণ বিচ্ছিন্নতাবোধ অনুভব করতাম। নিজের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ও প্রত্যাখ্যাত আমাকে বাধ্য করে আমার পরিবার জীবন শুরু করতে। এমনকি ধর্মান্তরিত হবার আগেও আমি সবসময় একজন ভালো মানুষের সাথে সম্পর্ক করতে চেয়েছি কিন্তু আমি এমন কোনো পুরুষকে খুঁজে পাইনি যারা আমার আর্দশের কাছাকাছি।

আমি জানতাম, মুসলমান হওয়াটা আমাকে সত্যিকার ভালোবাসা এবং ভাল জীবন সঙ্গী খুঁজে পেতে সাহায্য করবে। আমি সিদ্ধান্ত নেই, একজন ভালো মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে চাইলে এটাই হচ্ছে উপযুক্ত সময়। আমি পারিবারিকভাবেই বিয়ে করতে চেয়েছি।
আমি অনুসন্ধান করেছি, সাক্ষাত্কার নিয়েছি, আমার বন্ধুদের এবং পরিবারের লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি ভবিষ্যত সম্ভাবনা সম্পর্কে।

আমি সিদ্ধান্ত নেই আমার মতো অন্য একজন ধর্মান্তরিতকে বিয়ে করতে। যিনি হবেন আমার মতোই এবং তার গন্তব্যও হবে আমার মতো যেখানে আমি যেতে চাই।
আমার পিতামাতা ও বন্ধুদেরকে ধন্যবাদ জানাই। আমি আমার স্বামীকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে খুঁজে পেয়েছি যিনি আমার মতই একজন ধর্মান্তরিত মুসলিম। আমার স্বামী আলাবামাতে থাকতেন যা আমার নিউ অরলিন্সের বাসা থেকে মাত্র দুই ঘণ্টার পথ। বারো বছর পরেও আমরা আগের মতই সুখে বসবাস করছি।

সব মুসলিম তার সঙ্গিনীকে এই পদ্ধতিতে খুঁজে পায় না এবং আমিও আমার জীবনে এমনটি কখনও কল্পনা করিনি। কিন্তু আমি আনন্দিত যে ইসলাম আমাকে সামর্থ্য দিয়েছে এই অপশনটি গ্রহণ করার।

৯/১১ পরবর্তী বসবাস
মুসলিম হওয়ার পর আমি আমার ব্যক্তিত্বকে, আমার আমেরিকান পরিচয় বা সংস্কৃতিকে কখনই ত্যাগ করিনি। কিন্তু একটি সময়ে তাদের আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে এবং আমার মর্যাদা রক্ষার জন্য এগুলোকে ত্যাগ করতে হয়।

আমার দিকে থুথু ও ডিম নিক্ষেপ করা হয়েছে এবং আমাকে অভিশপ্ত করা হয়েছে যেন আমি গাড়ি চাপায় মারা যাই। জর্জিয়ার সাভান্নাহ মসজিদে নামাজের জন্য উপস্থিত হলে সন্ত্রাসীদের ভয় আমাকে তাড়া করত। মসজিদটিতে প্রথমে গুলি করা হয়, তারপর সন্ত্রাসীরা মসজিদটিকে পুড়িয়ে দেয়।
২০১২ সালের আগস্টে আমি নিউ অর্লিন্সের বাড়িতে ফিরে আসি যেখানে আদর্শ ছিল ভিন্ন প্রকৃতির। পরিশেষে আমি একটি সময়ের জন্য নিরাপদ অনুভব করলাম।

শুধুমাত্র রাজনৈতিক সুবিধার জন্য নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবি করা ও ইসলামকে বিকৃত করা এবং অন্যায়ভাবে ইসলামকে হাতিয়ার ব্যবহার করা আমাকে ভীষণভাবে ব্যথিত করে।
আমার দেশের লাখ লাখ লোক আমাকে ইসলাম ধর্মের প্রতিনিধি হিসাবে আইএসের এই কর্মকাণ্ড দেখে আমার সাথে খুবই খারাপ আচরণ করে।

আমি মনেপ্রাণে তাদের এই কর্মকাণ্ডকে ঘৃণা করি। তাদের এই কর্মকাণ্ডের জন্য যারা আমাকে ঘৃণা করতে থাকে তারা আমার বিশ্বাস সর্ম্পকে না জেনেই খারাপ আচরণ করে। এটি আমাকে মাঝে মাঝে অসহনীয় করে তুলে।

সর্বোপরি, আমার মধ্যে এই বিশ্বাস রয়েছে যে আমার সহকর্মী আমেরিকানরা সকল প্রকার ভয় এবং ঘৃণার উর্ধ্বে উঠে আমার মত একই বিশ্বাসে বিশ্বাসী হবে।
সূত্র : সিএনএন



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: