
কুরআনের হারিয়ে যাওয়া শহরে, ঘুরেছি ভরদুপুরে ।
- আবুল হোসেন আসাদ
সাইক্লিষ্ট ও সাইকেলে বিশ্ব অভিযাত্রী।
অজানা অচেনা গন্ধটা যখন তীব্রভাবে নাকে এসে লাগলো। তখন সিড়ি দিয়ে বেশ কিছুটা নিচে নেমে গেছি। ভরদুপুর, চারদিকে সুনশান নিরবতা। নিস্তব্দ পরিবেশে সিড়ি দিয়ে নিচের দিকে যেন নেমেই চলছি। পাথর কেটে বানানো সিড়ি দিয়ে যতই নিচের দিকে নামছি ততই বাতাসও কেমন যেন ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে। বাতাস বেশ ভারি মনে হচ্ছে।আর গন্ধটাও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। বিশ্রি ধরনের উৎকট গন্ধ নাকের মাঝ দিয়ে যেন মগজে আঘাত হানছে। শ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। ভিতরের দিকে ঘুট ঘুটে ভীষন অন্ধকার আর পোকামাকড়ের শব্দ। অক্সিজেনের ঘাটতিও প্রচুর। উৎকট গন্ধে মাথার মগজ যেন গুলিয়ে আসতো চাইলো, বমি এসে গেল প্রায়। কোন রকমে দৌড়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসলাম। বলছি একটি কুপের কথা। হারিয়ে যাওয়া একটি শহরের কথা। যার কথা রয়েছে আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনে। যেই শহরের নাম সেমেটিক ধর্ম বিশেষত ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিম ধর্মগ্রন্থগুলোতে ঘুরে ফিরে এসেছে। হারিয়ে যাওয়া শহরটি ‘উবার’ (টনধৎ), ওয়াবার (ডটনধৎ) কিংবা ‘ইরাম’ (ওৎধস) নামে পরিচিত। আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআনে আমরা আরবের হারিয়ে যাওয়া শহরটি ‘ইরাম’ নামে পাই।
ইরাম শহরটি ওমানের দোফার প্রদেশে পড়েছে। ওমানের শিসর এলাকায় এই পরিত্যক্ত শহরের অবস্থান। রাজধানী মাস্কাট থেকে ইরাম বা উবার শহরের দুরত্ব ৯০০ কিলোমিটার। আর বন্দরনগরী সালালাহ থেকে এর দুরত্ব ১৭০ কিমি, উত্তরদিকে। যাবার পথে মাঝে পড়ে মরু শহর তামরিদ।
‘ইরাম অব দ্য পিলার’ শহরটি ছিল সহস্র পিলারের এক সুরক্ষিত নগরী। উচু উচু পিলার দিয়ে কোন শহর হতে পারে- এটা তখন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। সেই শহরটি ছিল তখনকার সবচেয়ে চাকচিক্যময় ও আধুনিক শহর। ধর্মগ্রন্থগুলো বলছে, সেই শহরের মত শক্তিশালী বাড়ি-ঘর এর আগে কেউ কখনো দেখেনি বা নির্মাণ করেনি। সুরা আল ফজরের ৬, ৭ ও ৮ নম্বর আয়াতে ‘ইরাম’ শহরের কথা বলা হয়েছে। এখানে স্বয়ং আল্লাহ তার শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) কে ‘আদ’ বংশের শৌর্য-বীর্য সম্পর্কে বলেছেন। ইরাম শহরটি তৈরি হয়েছিলো উঁচু উঁচু পিলার দিয়ে। উচু উচু পিলারের এই সুরক্ষিত শহরটিতে বসবাস করত জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত ‘আদ’ জাতি।‘আদ’ সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা জোরদার করেছিল সুউচ্চ এই পিলার। ইরাম নগরীর কল্পিত ছবিই যেন সে কথা বলে । ইরামের সুউচ্চ পিলার আদ’দের নিরাপত্তা দিত বলে সেই উচু পিলারের পূজা করতো তাদের কেউ কেউ। আর বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজাতো নিয়মিত ছিলই ‘আদ’ দের।‘আদ’ সম্প্রদায়কে সুপথে আনার জন্য নবী হুদ (আঃ) কে প্রেরন করা হয়। তিনি ‘আদ’ সম্প্রদায়কে দ্বীনের দাওয়াত দেন। কুরআন শরিফ সুরা: হা-মীম সাজদাহ'র বিভিন্ন আয়াত এর বরাতে এ কথা জানা যায়। কিন্তু অধিকাংশ আদ সম্প্রদায়ের লোকেরা যুগের থেকে কয়েক কদম এগিয়ে থাকার গর্বে নবী হুদ (আঃ) কে তাচ্ছিল্যের সাথে বিদায় করে। তাদের কেউ কেউ আবার নবীকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়,‘আমাদের চেয়ে বড় শক্তিধর এ পৃথিবীতে আর কে আছে’?
ফলে প্রাথমিক ‘গযব’ হিসাবে উপর্যুপরি তিন বছর শহরে বৃষ্টি বন্ধ থাকে। তাদের শস্যক্ষেত শুকিয়ে বালুময় মরুভূমিতে পরিণত হয়। বাগ-বাগিচা জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যায় এবং সবশেষে নেমে আসে ভয়াবহ ‘আযাব’।
কুরআন শরীফ অনুসারে এভাবেই আদ সম্প্রদায় ও তাদের শহর ইরাম বা উবার বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং চিরতরে বালিতে চাপা পড়ে যায়। এবং কালের গর্ভে হারিয়ে যায়।
আর নবী হুদ (আঃ) এর কবর অটুট থাকে সালালাহর একটি পাহাড়ে। যেটি এখনো রয়ে গেছে যুগের পর যুগ, কালের করাল গ্রাস উপেক্ষা করে। হাজার বছরের পুরানো শহর ইরাম যা দীর্ঘকাল লুকিয়ে ছিল বিস্মৃতির অতলে, মরুভুমির বালির নিচে। তা অবশেষে ১৯৯২ সালের ফেরুয়ারি মাসে খুজে পাওয়া যায় ওমানের শিসর এলাকায়।‘দ্য লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এটি আবিষ্কারের কথা। প্রতœতত্ত¡বিদ নিকোলাস ক্লাপের উদ্যোগে প্রাচীন মানচিত্র ঘেঁটে এবং মার্কিন গবেষণা কেন্দ্র ‘নাসা’র স্যাটেলাইটের সাহায্যে খুঁজে পাওয়া যায় ‘রুবা-আল খালি’ মরুভুমির ১২ মিটার বালির নিচে লুকিয়ে থাকা ‘ইরাম’ বা ‘উবার’ শহরকে।
সুর্যটা ঠিক মাথার উপরে।গরম বাতাসের ভাপ বেরুচ্ছে যেন মরুভুমির বুকে। চোখ মেলে তাকানো বেশ কষ্টকর। বাড়তি জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে ভনভন করে তেড়ে আসা মরুভুমির বড় বড় মাছি। ভরদুপুরে দেখতে এসেছি কোরআনের ‘হারিয়ে যাওয়া শহর’ ইরাম বা উবার।
শুরুতে যে কুপটিতে নেমেছিলাম সে কুপ সম্পর্কে কেউ কেউ বলেন বাদশাহ শাদ্দাদ পৃথিবীর বুকে জান্নাত তৈরি করেছিলেন যার নাম ছিল ‘ইরাম’ বা ‘আরাম’। সেই জান্নাত স্রষ্টার অভিশাপে বালির নিচে চিরতরে হারিয়ে গেছে।এটিই ছিল সেই জান্নাত। কারো কারো ধারনা জান্নাতের এই প্রবেশদ্বারটি বিশাল এক পাথর চাপা পড়ে আছে। তবে অনেকেই মনে করেন বিশাল পাথর চাপা পড়া অংশটি হলো পানির কুপ। কেননা সহস্্র পিলারের শহরটির গোড়াপত্তন করেছিল নূহ (আঃ) এর বংশধরেরা। মরুভূমির কাফেলাগুলোকে পানি সরবরাহ করে তারা ধনী হয়ে উঠেছিল। পানির সেই কূপটি এখন বিশাল এক পাথরচাপা পড়ে আছে। যার একদিকে বর্তমানে সিঁড়ি তৈরি করে দেয়া হয়েছে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: