ঢাকা | মঙ্গলবার, ৬ মে ২০২৫, ২৩ বৈশাখ ১৪৩২

মধ্যযুগের সবচেয়ে সাহসী পরিব্রাজক

Akbar | প্রকাশিত: ৫ এপ্রিল ২০১৯ ২১:১১

Akbar
প্রকাশিত: ৫ এপ্রিল ২০১৯ ২১:১১

ডেস্ক: মরক্কোর তাঞ্জির শহরের এক মুসলিম হাকিমের পরিবারে ১৩০৪ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নেন ইবনে বতুতা। মধ্যযুগে সেই অনগ্রসর পরিবহণ ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও যিনি তার বিশ্বভ্রমণের অদম্য আকাঙ্খা দমিয়ে রাখেননি। তাই তো আজ মার্কো পোলো, ক্রিস্টোফার কলম্বাস, লুইস এন্ড ক্লার্কের সঙ্গে তার নামটিও সমস্বরে উচ্চারিত হয়। ১৩২৬ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে মক্কায় হজ্ব করার উদ্দেশ্যে জন্মভূমি ছাড়েন ইবনে বতুতা, সম্পূর্ণ একা। বাবা মাকে ছেড়ে সম্পূর্ণ অজানা অচেনা জায়গার উদ্দেশ্যে যাত্রার ব্যপারটি তাঁকে বড়ই ব্যথিত করে। নিজের চেনা গণ্ডির বাইরে সর্বপ্রথম যাত্রার নিঃসঙ্গতা সম্পর্কে পরবর্তীতে বতুতা তার ভ্রমণ বিষয়ক গ্রন্থ ‘রিহলা’তে উল্লেখ করেন, ‘আমি পথে বের হলাম একা। কোন সঙ্গী ছিলো না সান্ত্বনা দেয়ার মতো, কোন কাফেলা ছিলো না যাদের আনন্দ আয়োজনে আমি যোগ দিতে পারি। তাই প্রিয়জনকে ছেড়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্পকে আঁকড়ে ধরেই আমি পথ চলতে লাগলাম। পাখি যেমন তার বাসার মায়া ছিন্ন করে উড়ে যায়, আমিও তেমনি করে আমার ঘরবাড়ি পরিত্যাগ করলাম।’
মক্কায় যাওয়ার পথে ইবনে বতুতা চললেন মিসর এবং সিরিয়ার উপর দিয়ে, দেশ দু’টিতে তার বেশ কিছু বন্ধু জুটল, বিয়েও করলেন এক যুবতীকে। আলেক্সান্দ্রিয়ায় আশ্রয় নিলেন কিছুদিনের জন্য, যে শহরটিকে তিনি সুন্দর ও সুকৌশলে নির্মিত বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। আলেক্সান্দ্রিয়া সম্পর্কে পরবর্তীতে বতুতা বলেন, তার দেখা অন্যতম ৫ টি অনিন্দ্য সুন্দর জায়গার মধ্যে আলেক্সান্দ্রিয়া একটি। খ্রিস্টানদের জন্য সবচেয়ে পবিত্র স্থান জেরুজালেমের বেথেলহেম সফরের কথা তিনি বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। এক ফোঁটা কার্পণ্য করেননি সে শহরের সৌন্দর্য বর্ণনায়। আর দামাস্কাস নগরী সম্পর্কে বতুতার বিশ্লেষণ সৌন্দর্যের দিক দিয়ে তার দেখা অন্য সব শহরকে অতিক্রম করে যায় দামাস্কাস!

দামেস্কের উমাইয়াদ মসজিদকে তিনি উল্লেখ করেন তার দেখা সবচেয়ে সুনিপুণ স্থাপনা হিসেবে । তিনি এ মসজিদকে আখ্যায়িত করেন সৌন্দর্য, লাবণ্য ও পরিপূর্ণতার সবচেয়ে মহান উদাহরণ হিসেবে। দামেস্কে রমজান মাস থাকার পর বতুতা মদিনায় পৌঁছান, নিজ চোখে দর্শন করেন প্রিয় নবীর রওজা মুবারক। মক্কায় গিয়ে হজ্বও সম্পন্ন করলেন। ইবনে বতুতা চাইলেই তাঁর ভ্রমণ এখানেই থামিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরতে পারতেন। কিন্তু দুঃসাহসী অভিযানের নেশা, অজানা পথের মাদকতা তাকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিলো। ইবনে বতুতা প্রায়ই স্বপ্নে দেখতেন তিনি পাখির ডানায় ভর করে উড়ে বেড়াচ্ছেন, সামনে যে দেশ পড়ছে সেখানেই পাখির ডানা থেকে নেমে সেখানকার রঙ, রূপের আশ্বাস নিচ্ছেন। বহুবার তিনি তার এই স্বপ্নের উল্লেখ করেছেন।

মধ্যযুগে দূরদেশ ভ্রমণের চেয়ে কষ্টসাধ্য কিছু ছিলোনা। ভ্রমণ করতে গিয়ে পথে ইবনে বতুতা ডাকাতির কবলে পড়েছেন, হামলার স্বীকার হয়েছেন, জাহাজডুবি হয়েছে, নিতান্ত সঙ্গী হিসেবে ডায়রিয়া, জ্বর আর দুর্বিষহ একাকীত্ব তো ছিলই! কখনো উটের পিঠে, কখনো পায়ে হেঁটে, জাহাজে চেপে আবার কখনো বা ঝুঁকি এড়ানোর জন্য অন্যান্য তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে একত্রে ভ্রমণ করেছেন। সৌভাগ্যবশত, ইবনে বতুতা যেসব জায়গায় ভ্রমণ করেছেন সেসব দেশের অধিকাংশ শাসকই ছিলেন মুসলিম। একজন মুসলিম বিদ্বান ও অভিযাত্রী হিসেবে তিনি সেসব মুসলিম শাসকদের কাছে বেশ সম্মানিত হতেন। তারাই মূলত বতুতার থাকার জন্য জায়গা, খাবার ও পথের খোরাক যোগাতেন। বতুতা নতুন নতুন জায়গায় গিয়ে সেখানকার মসজিদ ও হাঁট-বাজারে ঘুরে বেড়াতেন, মানুষজনের খাদ্যাভ্যাস, কাপড়-চোপড়, স্থানীয় রীতি নীতি ইত্যাদি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। এছাড়াও তিনি যুক্তিবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করতেন এবং স্থানীয় মামলা মোকদ্দমার সমাধান দেয়ার জন্য বিচারক হিসেবে কাজ করতেন।

১৩৩১ সালে জাহাজে করে ইবনে বতুতা লোহিত সাগর পাড়ি দিলেন। পথে পড়ল ইয়েমেন, আফ্রিকার শিং খ্যাত ইথিওপিয়া এবং সোমালিয়া। এরপর আর একবার হজ্ব পালন করে চলে যান ফিলিস্তিন। কনস্টান্টিনোপলে গিয়ে হ্যাগিয়া সোফিয়ার জাদুঘর দেখে মুগ্ধ হন ইবনে বতুতা, কিন্তু খ্রিস্টান না হওয়ায় সেখানকার রীতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে তিনি এর ভেতরে প্রবেশ করেননি। সে দেশেই বাইজান্টাইন সম্রাটের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এরপর তার গন্তব্য হয় আফগানিস্তান, সেখান থেকে তুষার ঢাকা হিন্দুকুশ পর্বত পাড়ি দিয়ে তিনি ভারতে পৌঁছান।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: