
ডেস্ক: সম্প্রতি রাজধানীতে ঘটে যাওয়া অগ্নিদুর্ঘটনারগুলোর প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)। তারা কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে, বিদ্যমান আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাব, যত্রতত্র বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ, ব্যক্তি বা গোষ্ঠিস্বার্থে ভূমি ব্যবহারের নির্বিচার পরিবর্তন, অনুমোদিত ইমারত নকশার ব্যত্যয় করে ভবন নির্মাণ করা।
এ প্রসঙ্গে জোনিং অধ্যাদেশ প্রস্তুতকরণ, এলাকাভিত্তিক ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) প্রণয়ন এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সব স্তরে পরিকল্পনাবিদদের অন্তর্ভূক্ত করা প্রয়োজন।
নগর পরিকল্পনাবিদদের জাতীয় পেশাজীবী সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর নিজস্ব কার্যালয়ে আয়োজিত ‘অগ্নিদুর্ঘটনা ও ভবন নিরাপত্তা’ বিষয়ক আলোচনা সভায় এ সব মতামত উঠে এসেছে। আলোচনা সভায় ইমারত সংশ্লিষ্ট আইনগুলোর যথার্থ প্রয়োগের মাধ্যমে ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের উপর জোর দেয়া হয়।
ইনস্টিটিউটের সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. এ কে এম আবুল কালাম আলোচনার শুরুতে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া চুড়িহাট্টা ও বনানীর অগ্নিদুর্ঘটনায় নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন।
তিনি বলেন, পুরান ঢাকার অনুরূপ নতুন ঢাকাও ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এর প্রধান কারন হিসেবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট অবহেলা লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানসমূহের আইন প্রয়োগ ও নজরদারীতে গাফিলতির বিষয়ে তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
পরিকল্পনাবিদ সালমা এ শফি বলেন, যেকোনো ভবন নির্মাণের সময় ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র প্রদানের ক্ষেত্রে মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে। শুধু পরিকল্পনা অনুমোদনের স্তরেই পরিকল্পনাবিদদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ নয় বরং যেকোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সব ধাপে পরিকল্পনাবিদদের অন্তর্ভূক্তিকরণের উপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। যেকোনো ধরনের পরিকল্পনা বহির্ভূত কার্যক্রমের বিরুদ্ধে পরিকল্পনাবিদদের সোচ্চার হতে হবে।
পরিকল্পনাবিদ খন্দকার নিয়াজ রহমান বলেন, স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে যেকোনো ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে। এক্ষেত্রে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট সব নির্বাহী ক্ষমতা সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভা মেয়রের অধীনে থাকা আবশ্যক বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
পরিকল্পনাবিদ আল আমিন তার বক্তব্যে ভূমির মিশ্র ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করেন। এক্ষেত্রে তিনি নির্দিষ্ট জোনিং অধ্যাদেশ ও এলাকা ভিত্তিক ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) প্রনয়নের কথা উল্লেখ করেছেন।
ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রাজউকের তৎপরতা বিদ্যমান রয়েছে। অতি শিগগিরই রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ করা হবে। সে মোতাবেক দ্রুত যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিআইপি-এর সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, দ্রুত বর্ধনশীল মেগাসিটি ঢাকা অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলশ্রুতিতে অগ্নিদুর্যোগসহ নানা ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপনের আইন অমান্য করে স্থাপনা তৈরি, অপরিকল্পিত ও যত্রতত্র বাসস্থান নির্মাণ, অপরিকল্পিতভাবে বাণিজ্যিক ভবন ও শিল্প-কারখানা স্থাপন মূলত এসবই অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতার জন্য দায়ী।
অগ্নি প্রতিরোধ আইনে বলা আছে প্রতিবার অকুপেন্সি বা ভাড়াটে বদল হলে নতুন করে হালনাগাদ করা আইনের অধীনে ছাড়পত্র নিতে হবে, যা বেশিরভাগ ভবন নির্মাণকারী অমান্য করছে। একটি দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন তদন্ত কমিটি কারণ অনুসন্ধান করে কিছু সুপারিশ দেয় কিন্তু সুপারিশগুলোর কোন বাস্তবায়ন হয় না।
তিনি বলেন, রাজউক, সিটি কর্পোরশন বা বিভিন্ন কমিটি আছে- তাদের উচিত সুপারিশগুলো নিয়ে দ্রুত অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা। অ্যাকশন প্ল্যান কতদিনের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে, সে বিষয়েও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা থাকা আবশ্যক। সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন করতে একটি ফাইনান্সিয়াল প্ল্যানও করা প্রয়োজন।
অনেক সময় ভবনের অধিক লাভের আশায় ফ্লোর স্পেস বাড়ানোর জন্য কমন স্পেসগুলো কমিয়ে ফেলা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, কমন স্পেস ভূমিকম্প ও অগ্নিকাণ্ডের সময় খুবই কাজে লাগে। এছাড়াও ভবনগুলোর অভ্যন্তরীণ ওয়্যারিং সমস্যা থেকে বৈদ্যুতিক শর্ট-সার্কিটও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে থাকে উল্লেখ করে সুউচ্চ ইমারতসমূহের ইলেট্রিক্যাল অডিট প্রয়োজন।
আলোচনা সভায় উপস্থিত পরিকল্পনাবিদরা ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড সম্পূর্ণরূপে মেনে চলা, প্রয়োজনীয় ফায়ার কমপার্টমেন্টেশনের ব্যবস্থা করা, এছাড়াও ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অগ্নিপ্রতিরোধক উপকরণ ব্যবহারের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। ফায়ার ড্রিল, ফায়ার হাইড্রেন্ট, স্প্রিংকলার, ফায়ার ডোর এবং অগ্নিকাণ্ডের ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া বের হওয়ার জন্য পৃথক নির্গমন পথের ব্যবস্থা থাকতে হবে বলে পরিকল্পনাবিদরা উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স এর সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. এ কে এম আবুল কালামের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খানের সঞ্চালনায় সভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিআইপি- এর সহ-সভাপতি ২ পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন, যুগ্ম সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম প্রমুখ।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: