ঢাকা | মঙ্গলবার, ৬ মে ২০২৫, ২২ বৈশাখ ১৪৩২
শিশু ধর্ষণ

ছেলেরা কেন বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে?

odhikar patra | প্রকাশিত: ২২ আগস্ট ২০১৯ ০২:০৫

odhikar patra
প্রকাশিত: ২২ আগস্ট ২০১৯ ০২:০৫

ঢাকার হাই কোর্ট ভবন, ২০১৮ সালে তোলা ছবি।হাইকোর্ট বিভাগ এক রায়ে ছেলে শিশুর ধর্ষণের ব্যাপারে অস্পষ্ট ধারনা থাকার বিষয়টি ইঙ্গিত করে।

কন্যা শিশু ধর্ষণের পাশাপাশি গত কয়েক বছর জাতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোতে ছেলে শিশু ধর্ষণের ঘটনাও নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে 'নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন' নামে একটি আলাদা কঠোর আইন থাকলেও বর্তমানে ছেলে শিশুর ধর্ষণের বিচার অনেক ক্ষেত্রেই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে না হয়ে প্রচলিত ফৌজদারি আইনের অধীনেই হচ্ছে।

আইনের ব্যাখ্যা সম্বন্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আর বিচার ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অস্পষ্ট ধারনা এর একটি বড় কারণ।

আর তাতে করে প্রাপ্য বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে যৌন সহিংসতার শিকার ছেলে শিশুরা।

বর্তমান প্রেক্ষাপট

বেসরকারি তথ্য সূত্র মতে, এই বছরের মে মাস পর্যন্ত প্রায় ২৩৩টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ৬টি ছেলে শিশু (সূত্র: মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন)।

তবে ধর্ষণের শিকার শিশুদের নিয়ে মাঠ পর্যায়ে গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে ধারনা করা যায়, ছেলে শিশু ধর্ষণের ঘটনা প্রাপ্ত তথ্য থেকে বাস্তবে আরও অনেক বেশি হওয়ার কথা।

তবে সেই পরিসংখ্যানটি কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্যে পুরোপুরি উঠে আসাটা হয়তো কঠিন। কেননা শিশুরা, বিশেষ করে ছেলে শিশুরা খুব কম ক্ষেত্রেই তার বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া যৌন অপরাধের কথা প্রকাশ করতে পারে।

যৌনতা সম্বন্ধে ধারনা না থাকায়, অথবা অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধীর মাধ্যমে বিভিন্ন ভয়-ভীতি বা হুমকির শিকার হয়ে ছেলে শিশুরা যৌন হয়রানি বা নির্যাতনের অভিযোগ গোপন করে।

তাছাড়া, পরিবার বা এলাকার প্রাপ্তবয়স্কদের কাছেও একজন ছেলে শিশুর বিরুদ্ধে হওয়া যৌন অপরাধও যে আইনত ধর্ষণ হবে, বা এর বিরুদ্ধে যে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যাবে, এই ব্যাপারটিই স্পষ্ট নয়।

শিশু ধর্ষণের বিরেুদ্ধে ঢাকায় প্রতিবাদ, ১০-০৭-২০১৯।প্রতীকী প্রতিবাদ: বেসরকারি তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে ২৩৩জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

'ধর্ষণ নয়' বলাৎকার কেন?

অভিধানগুলোতে সাধারণত 'ধর্ষণ'-এর সমার্থক শব্দ হিসেবে 'বলাৎকার'-কে ব্যবহার করা হলেও, প্রচলিত ধারণাটি হল একজন পুরুষ যখন ধর্ষণের শিকার হয়, তখন তাকে বলাৎকার বলা হবে - ধর্ষণ নয়।

লক্ষণীয় যে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জাতীয় পত্রিকাগুলোতে ছেলে শিশু ধর্ষণের খবর প্রচার করার সময় 'বলাৎকার' শব্দটিই ব্যবহার করা হয়।

এমনকি পুলিশসহ বিচার ব্যবস্থায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাছেও ছেলে শিশুর ক্ষেত্রে আইনত ধর্ষণ হবে কিনা, এই বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই পরিষ্কার নয়।

এই ধারণার পিছনে প্রচলিত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে, যা ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি হিসেবে শুধু নারীকেই কল্পনা করে। ঠিক একই কারণে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকে বুঝাতে অভিধানগুলোতে 'ধর্ষিতা'র মত স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।

শুধু তাই নয়, খোদ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনেই 'ধর্ষিতা' শব্দটি স্থান পেয়েছে।

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট ভবনের করিডোর।সুপ্রিম কোর্টের করিডোর: প্রচলিত আইনে রয়েছে অনেক অস্পষ্টতা।

প্রচলিত আইনে অস্পষ্টতা

ধর্ষণকে সাধারণভাবে শুধুমাত্র নারীর বিরুদ্ধে হওয়া যৌন অপরাধ মনে করার পিছনে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি বর্তমান আইনের অস্পষ্টতাও অনেকাংশে দায়ী।

বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ধর্ষণকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে তাতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ধর্ষণের শিকার হতে পারে শুধু একজন 'নারী', একজন পুরুষের মাধ্যমে (দণ্ডবিধি ধারা-৩৭৫)। শুধু তাই নয়, দণ্ডবিধির সংজ্ঞাটি বলছে, ধর্ষণের ক্ষেত্রে যৌন সঙ্গম বিবেচনা করার জন্য 'পেনেট্রেশন'-ই (প্রবিষ্ট করা) যথেষ্ট।

অথচ সংজ্ঞাটিতে কোথাও 'পেনেট্রেশন'-এর ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি।

স্বভাবতই তাই বিচার প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেই ধর্ষণকে নারী-পুরুষের মধ্যে স্বাভাবিক যৌন সঙ্গমের প্রচলিত ধারনাকেই বুঝে থাকেন। ব্রিটিশ আমলে প্রণীত দণ্ডবিধির ধর্ষণের এই সংজ্ঞাটি তাই ছেলে শিশুর ধর্ষণকে ধর্ষণ না বলার পিছনে একটি অন্যতম কারণ।

তবে দণ্ডবিধি থাকা সত্ত্বেও নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা কঠোরভাবে দমন করতে ২০০০ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিল 'নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন'। এই আইনটিতে 'শিশু'র যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, তাতে কোন লিঙ্গ বিশেষে নয় বরং ১৬ বছরের কম বয়সী যে কোন শিশুই এই আইনে বিচার পাওয়ার কথা।

ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে শিশু ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ , ৩১-০৩-২০১৮।
শিশু ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ: কিন্তু আইনের জটিলতার কারণে ছেলে শিশুরা বিচার পাচ্ছে না।

যেহেতু বর্তমানে প্রায় সব ধর্ষণের মামলাই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচার হচ্ছে, তাই স্বাভাবিকভাবে একজন সহিংসতার শিকার ছেলে শিশুর বিচারও আইনত এই আইনটির অধীনেই হওয়া উচিৎ।

'ধর্ষণ'-এর সংজ্ঞার ক্ষেত্রে 'নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন' বলছে, দণ্ডবিধির ৩৭৫ -এ দেয়া ধর্ষণের সংজ্ঞাটিই বলবৎ থাকবে, তবে তা হবে এই আইনের ধারা ৯-এর বিধান সাপেক্ষে।

ধারা ৯-এ ধর্ষণকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত না করলেও ধারার শুরুতেই বলা হয়েছে, "যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন ......." অর্থাৎ, দণ্ডবিধির সংজ্ঞায় শুধু নারী ধর্ষণের শিকার হতে পারে বলা থাকলেও ধারা ৯-এর অধীনে 'শিশু'কেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

আবার যেহেতু আইনে শিশু বলতে যে কোন লিঙ্গের শিশুকেই বোঝানো হচ্ছে, তাই সঠিক আইনি ব্যাখ্যা অনুযায়ী ছেলে শিশু ধর্ষণকেও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনেই বিচার করতে হবে।

তবে, গুরুত্বপূর্ণ হল 'পেনেট্রেশন' বলতে আসলে কী কী ধরনের যৌন সঙ্গমকে বুঝাবে, তা কোন আইনেই নির্দিষ্ট করা নেই। তাই পুলিশের কাছে যখন ধর্ষণের শিকার ছেলে শিশুর পক্ষ হয়ে বিচার চাওয়া হয়, তখন তার মামলাটি অনেক সময়ই 'নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে'র ধারা ৯-এ নেয়া হয় না।

অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মামলার এফআইআর রুজু হয় বরং দণ্ডবিধির ধারা ৩৭৭-এ। ব্রিটিশ আমল থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই ৩৭৭ ধারা, আসলে সমকামিতাসহ 'প্রাকৃতিক' নিয়মের বিরুদ্ধে করা কোন যৌন সঙ্গমকে দণ্ডনীয় করছে।

সমলিঙ্গের মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার ছেলে শিশুকেও তাই ৩৭৭-এর অধীনেই বিচার চাইতে হয়।

এই ধারায় (৩৭৭-এ) অপরাধী বা অপরাধের শিকার ব্যক্তির বয়স, সম্মতি বা অসম্মতির প্রশ্নও অপ্রাসঙ্গিক। আবার, 'নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে'র ৯ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেও, ৩৭৭-এ সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং তাতে কোন সর্বনিম্ন শাস্তির বিধান নির্দিষ্ট করা নেই।

অর্থাৎ, আইন প্রয়োগকারীদের আইন সম্বন্ধে অস্পষ্ট ধারণা থাকার কারণে ধর্ষণের শিকার বেশিরভাগ ছেলে শিশুই 'নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে'র কঠোরতম শাস্তির বিধান আর দ্রুত বিচার ব্যবস্থার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত

ধারা ৯-এর পাশাপাশি বাংলাদেশের উচ্চ আদালত থেকেও এই ব্যাখ্যাটিকে সমর্থন করে ২০১৩ সালের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে।

আবদুস সামাদ বনাম রাষ্ট্র (৯ বিএলসি, ২০১৪, পাতা-১৭১) - এই মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ স্পষ্ট সিদ্ধান্ত দেন যে, ১৬ বছরের নিচে যে কোন ছেলে শিশুর বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা 'নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে'র ধারা ৯-এর অধীনেই বিচার্য হবে, দণ্ডবিধিতে নয় - এমনকি যদি যৌন সঙ্গমে শিশুর সম্মতিও থেকে থাকে। কেননা ধারা ৯ বলছে, ১৬ বছরের নীচে যে কোন শিশুর সাথে যৌন সঙ্গমকেই ধর্ষণ বলা হবে এবং শিশুর সম্মতি ছিল কিনা, তা বিচার্য হবে না।

সম্পূর্ণ রায়ে আদালত ছেলে শিশুর ধর্ষণের ব্যাপারে বিচার ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অস্পষ্ট ধারনা থাকার বিষয়টিও ইঙ্গিত করেন।

কী করনীয়?

প্রথমত, আইনি ব্যাখ্যায় ছেলে শিশুর ধর্ষণকে ধারা ৯-এ অন্তর্ভুক্ত করা গেলেও প্রচলিত আইনে যে অস্পষ্টতা রয়েছে তা দূর করা প্রয়োজন। দণ্ডবিধির ধারা ৩৭৫-এ ধর্ষণের সংজ্ঞায় ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকে বুঝাতে নারীর পাশাপাশি 'শিশু' শব্দটি যুক্ত করতে হবে।

একই সাথে দণ্ডবিধির ৩৭৫-এর সংজ্ঞায় 'পেনেট্রেশন' বা 'প্রবিষ্ট করা' এই শব্দটির একটি যথাযথ ব্যাখ্যা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যাতে সমলিঙ্গের মাধ্যমে যৌন সঙ্গমকেও 'পেনেট্রেশন' বলা যায়।

পাশাপাশি 'নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে' 'শিশু'র সংজ্ঞায় ছেলে, মেয়ে বা অন্য কোন লিঙ্গ পরিচয়ের অনধিক ১৬ বছর বয়সী শিশুর কথা সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা যেতে পারে, যেকোন ধরনের অস্পষ্টতা দূর করার জন্য।

যেহেতু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে বিচার ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই এই বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট ধারনা রাখেন না, তাই থানা পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্য থেকে শুরু করে আইনজীবী, বিচারক এবং পাবলিক প্রসিকিউটারদেরকেও এই বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া প্রয়োজন।

একই সাথে জাতীয় পর্যায়েও সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নেয়া জরুরী, যাতে করে ছেলে শিশুও যে ধর্ষণের বিচারের বাইরে নয়, সেটি সাধারণের কাছে স্পষ্ট হয়।

সর্বোপরি ধর্ষণকে ধর্ষণই বলতে হবে, 'বলাৎকার' নামকরণ করে এই অপরাধের মাত্রা কমানোর কোন সুযোগ নেই।

Bbc Bangla 

(তাসলিমা ইয়াসমীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক এবং একজন গবেষক)



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: