Image copyrightREUTERSমার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, শনিবারের হামলা ছিল একটা যুদ্ধ ঘোষণা।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, শনিবারের হামলা ছিল একটা যুদ্ধ ঘোষণা।

সৌদি আরব বলছে, শনিবার সৌদি তেল শোধনাগারের ওপর ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পেছনে যে ইরান রয়েছে সেই প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে। ইরানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে: এ নিয়ে কী ঐ দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যেতে পারে?

যে মাত্রায় হামলার ঘটনাটি ঘটেছে সৌদি আরব তা কোনমতেই এড়িয়ে যেতে পারবে না। এবং ইরানই যে ঐ হামলার জন্য দায়ী সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পর সৌদি আরবকে একটা পাল্টা জবাব দিতেই হবে।

ঐ হামলার ঘটনাটি জাতিসংঘ এখন তদন্ত করে দেখছে। সেই তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সৌদি সরকার সম্ভবত অপেক্ষা করবে।

এর ফলে যে কোন পদক্ষেপ নেয়ার আগে সৌদি সরকার কিছুটা সময় হাতে পাবে। যদিও বিশেষজ্ঞরা সবাই একমত যে ইরানের বস্তুগত সাহায্য এবং নির্দেশনা ছাড়া ঐ হামলার ঘটনা ঘটানো অসম্ভব।

বাজির খেলায় ইরান

ইরানের তরফ থেকে ঐ হামলার দায়দায়িত্ব শুধু অস্বীকার করলেই যথেষ্ট হবে না।

Image copyrightREUTERSসৌদিরা বলছেন, ক্ষেপণাস্ত্র হামলার দিক হিসেব করলে বোঝা যাবে সেটা ইয়েমেন থেকে আসতে পারে না।
সৌদিরা বলছেন, ক্ষেপণাস্ত্র হামলার দিক হিসেব করলে বোঝা যাবে সেটা ইয়েমেন থেকে আসতে পারে না।

সৌদি আরব এবং তার মিত্র দেশগুলো বিশ্বাস করে যে ইরান এই বিষয়ে তাদের বাজির মাত্রা বাড়াতে চায় এই লক্ষ্যে যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেন ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।

গত বছর ইরানের সাথে একটি পরমাণু চুক্তি মি. ট্রাম্প একতরফা-ভাবে প্রত্যাহার করেন এবং নতুন করে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।

ইরানের নেতারা আশা করছেন, পারস্য উপসাগরে যুদ্ধের সম্ভাবনা বাড়লে বিশ্ব নেতারা টের পাবেন ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা কতোটা বিপজ্জনক হতে পারে।

ইরানের নেতারা আশা করছিলেন, পরমাণু চুক্তি পালন করার মধ্য দিয়ে এবং ঐ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ণ না করার শর্তে, ইরান ফ্রান্সের কাছ থেকে ১৫০০ কোটি ডলার ঋণ সুবিধে পাবে।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেই পরিকল্পনায় সায় দেননি। শুধু তাই না, গত বুধবার মি. ট্রাম্প মার্কিন অর্থমন্ত্রীকে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়া নির্দেশ দিয়েছেন। ফলে, ইরান এই বাজিতে দৃশ্যত হেরে গেছে বলেই মনে হচ্ছে।

সৌদি আরবের ওপর যে মাত্রায় আঘাত হানা হয়েছে, তা ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ খামেনির অনুমোদন ছাড়া ঘটা অসম্ভব ছিল।

গত সপ্তাহে মি. খামেনি যে ভাষণ দিয়েছেন তাতে সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় তেল শোধনাগারে হামলার কোন কথা কিংবা ঐ অঞ্চলে যে কোন মুহূর্তে লড়াই বেধে যাওয়ার সম্ভাবনার কথার লেশমাত্র ছিল না।

Image copyrightAFPআয়াতোল্লাহ খামেনি বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে পর্যুদস্ত করতে চায়।
আয়াতোল্লাহ খামেনি বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে পর্যুদস্ত করতে চায়।

 

এর বদলে, ঐ ভাষণে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যে কোন পর্যায়ে আলোচনাকে তিনি খারিজ করে দেন।

তবে আজ হোক কাল হোক, আয়াতোল্লাহ খামেনিকে হয়তো তার অবস্থান পরিবর্তন করতে হতে পারে এবং আলোচনার টেবিলে ফিরে যেতে হতে পারে, ইরানের নরমপন্থী নেতারা যেটা আশা করছেন।

ইরানের ভঙ্গুর অর্থনীতি

ইরানের তেল রপ্তানি এখন শূন্যের কোঠায়। এর অর্থের মজুদ দ্রুত ফরিয়ে আসছে। এখন যা বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে তা দিয়ে মাত্র কয়েক মাস চলবে।

ইরানি মুদ্রার মান কমে আসার ফলে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে ৪০%। এর ফলে ইরানিদের ক্রয়ক্ষমতা প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে।

তাই, অনেক ইরানির জীবনযাত্রাই এখন কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

সৌদি সামরিক পদক্ষেপের বিপদ

তাহলে ইরানকে হটিয়ে দিতে সৌদি আরব কী সামরিক ব্যবস্থা নিতে পারে?

তেমন সম্ভাবনা কম বলেই মনে হচ্ছে। ইরানের জনসংখ্যা এখন ৮ কোটি। অন্যদিকে সৌদি আরবের জনসংখ্যা ৩.৩ কোটি।

Image copyrightGETTY IMAGESড্রোন হামলায় জ্বলছে সৌদি আরবের আবকাইক তেল শোধনাগার।
ড্রোন হামলায় জ্বলছে সৌদি আরবের আবকাইক তেল শোধনাগার।

ইরান তার অস্ত্রভাণ্ডারে হাজার হাজার মিসাইল মজুদ রেখেছে। সৌদি তেল-ক্ষেত্র, শোধনাগার, সামরিক ঘাঁটি এবং জনবহুল শহরগুলো এর লক্ষবস্তুতে পরিণত হতে পারে।

তুলনামুলকভাবে সৌদি আরবের অস্ত্রভাণ্ডারে শত শত চীনা মিসাইল থাকলেও তাদের মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বেশ দুর্বল।

সৌদি বিমান বাহিনীতে জঙ্গি বিমানের সংখ্যা ইরানের প্রায় সমান। তবে সৌদি বিমানগুলো বেশ আধুনিক এবং কার্যকর। অন্যদিকে ইরানের বিমান বাহিনীর জঙ্গি বিমানগুলো বেশ পুরনো এবং অদক্ষ।

পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ইরানের মিত্ররা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সৌদি আরবের শিয়া জনগোষ্ঠীর সমর্থনও ইরান পাবে।

ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি আরব ইতোমধ্যেই এক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। এই যুদ্ধের জন্য তার প্রচুর অর্থব্যয় হচ্ছে।

তবে যদি সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে কোন সরাসরি লড়াই শুরু হয়, তাহলে দু'পক্ষকেই নির্ভর করতে হবে বিমান বাহিনী এবং ক্ষেপণাস্ত্র শক্তির ওপর। কিন্তু ঐ যুদ্ধে কোন পক্ষেরই নিরঙ্কুশ বিজয় হবে না।

উপসাগর উত্তপ্ত

Image copyrightMARWAN NAAMANIহরমুজ প্রণালীতে চলছে তেলবাহী জাহাজের বহর।
হরমুজ প্রণালীতে চলছে তেলবাহী জাহাজের বহর।

পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন সেনা, বিমান এবং নৌবহর মোতায়েন থাকলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোন দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে নারাজ।

কারণ, লড়াই শুরু হলে মার্কিন সেনা-ঘাঁটি এবং নৌবহরগুলো ইরানি হামলার ঝুঁকিতে পড়ে যাবে।

এছাড়া, বিশ্বের সর্বমোট তেল চাহিদার এক পঞ্চমাংশ হরমুজ প্রণালী দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেটিও তখন যুদ্ধের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে।

যুদ্ধের পটভূমিতে মার্কিন নির্বাচন

যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসছে। এ পরিস্থিতিতে মার্কিন পেট্রোল পাম্পগুলোতে তেলে দাম হঠাৎ করে আকাশ-ছোঁয়া হয়ে গেলে মি. ট্রাম্পের আবার নির্বাচনে জেতার আশা কঠিন হয়ে পড়বে।

সৌদি আরবের জন্য মার্কিন সমর্থন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মি. ট্রাম্প চাইছেন, এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে হবে সৌদি আরবকে এবং তাকে সাহায্য করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের যে ব্যয় হবে সৌদি সরকার সেটি পুষিয়ে দিলেই তিনি খুশি।

ইরানের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার প্রশ্নে সৌদি আরব তার দুই প্রতিবেশী সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইনকেও পাশে চায়।

ইরানের সাথে সৌদি যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র তার ইয়োরোপীয় মিত্র দেশগুলোর কাছ থেকে রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সমর্থন চাইতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো ইয়োরোপীয় দেশগুলো মনে করে এখন ইরানকে ঘিরে যে পরিস্থিতি তার সূত্রপাত ইরানের পরমাণু চুক্তি থেকে মি. ট্রাম্পের সরে আসার একক সিদ্ধান্ত।

ইরানের ভেতরে যার কট্টরপন্থী রয়েছেন তাদের এখনকার ভাবনা, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের প্রশ্নে পদক্ষেপ না নিয়ে দেশকে আরেকটা যুদ্ধের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কৌশল আসলে কতোটা সুবিবেচকের কাজ হবে।

বিবিসি