odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Friday, 14th November 2025, ১৪th November ২০২৫
ব্যাপক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে বর্জ্যজীবী নারী ও শিশুরা

বর্জজীবীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশের সংবিধান স্বাস্থ্যনীতি, স্বাস্থ্য ও সেবার অধিকার বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

Mahbubur Rohman Polash | প্রকাশিত: ১৭ September ২০১৮ ২৩:৫৫

Mahbubur Rohman Polash
প্রকাশিত: ১৭ September ২০১৮ ২৩:৫৫

বাংলাদেশে অত্যন্ত দরিদ্র একজনগোষ্ঠী নানা ধরণের গৃহস্থালী বর্জ্য থেকে পুনব্যবহার যোগ্য নানা সামগ্রী সংগ্রহের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। সারাদেশে প্রায় ৪ লাখ মানুষ এই ঝূঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়েজিত রয়েছে। শুধু ঢাকা মহানগরীতেই এই সংখ্যা ১ লাখের ওপর। এদের মধ্যে কেউ রয়েছে বর্জ্য সংগ্রহের কাজে, কেউ বাছাই করার কাজে, আবার কেউ বা রয়েছে এসব বিক্রি করার কাজে। যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।

সমাজে এদের পরিচয় ময়লা কুড়ানি নামে। যারা রাস্তা, ডাস্টবিন বা ডাম্পসাইট থেকে বর্জ্য সংগ্রহ ও তা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। এদেরই একজন ত্রিশোর্ধ হালিমা। বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় স্বামী তালাক দেয়। এরই মধ্যে দু’টি সন্তানের জন্ম দেয় সে। কিন্তু সংসারের হাল ধরতে তাকে বেছে নিতে হয় এই পেশা। ভোর থেকে সন্ধ্যা সারাদিন চলে বর্জ্য সংগ্রহের কাজ। বর্জ্য বিক্রি করেই চলে তার সংসার। কখনো খাবার জোটে দু’বেলা কখনো একবেলা।
তিন সন্তানের জননী চল্লিশ উর্ধ্ব রোকসানা বেগমের স্বামী মাদকাসক্ত। সাত সদস্যের সংসারে উপার্জনক্ষম বলতে রোকসানা। দুই ছেলে, এক মেয়েকে এ কাজে লাগিয়ে চলছে তাদের সংসার। একটি শিশু বর্জ্য থেকে দিনে প্রায় ১শ’ থেকে ৩’শটাকা উপার্জন করে থাকে।
হালিমা-রুখসানার মত এই পেশায় নিয়োজিত অনেকেরই গল্প একই রকম। খেয়ে না খেয়ে দুটো টাকা পাওয়ার আশায় নিরন্তর ছুটছে বর্জ্য সংগ্রহের কাজে। কিন্তু একবারও ভেবে দেখছে না কি অপেক্ষা করছে এসব দরিদ্র মানুষের ভাগ্যে।

ডাম্পিং সাইটে ট্রাকে করে বর্জ্য ফেলার পর ক্ষতিকর বর্জ্য, হাসপাতালের বর্জ্য রাসায়নিক দ্রব্য, পঁচা, বাসী গৃহস্থালীর বর্জ্য, মানুষ ও পশুর মলমুত্র সব মিলিয়ে মারাত্বক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এসব কাজের সঙ্গে সম্পৃক্তরা। ডাম্পিং সাইটে কাজ বর্জ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সেখানে ফেলে দেয়া সুঁই, বে¬ড, সিরিঞ্জ দিয়ে প্রতিনিয়ত জখম হচ্ছে তারা। ফেলে দেয়া দূষিত পদার্থের সংস্পর্শে প্রায়শই আক্রান্ত হচ্ছে আমাশয়, ডাইরিয়া, হেপাটাইটিস ভাইরাস ও চমর্রোগসহ বিভিন্ন রোগে।
ডাম্পিং সাইটে দীর্ঘক্ষণ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থেকে সেখান থেকে ফেরার পর শিশুরা হাত না ধুয়েই সেরে নিচ্ছে তাদের দুপুরের খাবার। ফলে এসব শিশু ক্ষুধামন্দা, বমি বমি ভাব ও মাথা ঘুরানোসহ নানা সমস্যায় ভুগছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রচন্ড দুর্গন্ধের মধ্যে কাজ করে তারা সবসময় ভুগছে গ্যাস্ট্রিকে। ডাম্পিং সাইটে কাজ করার সময় তারা অনেক সময় বর্জ্যবাহী ট্রাক ও লেভেলিং মেশিন দিয়ে বা বুলডুজার দিয়ে দুর্ঘটনার স্বীকার হচ্ছে। এতে করে অনেক শিশুর অঙ্গহানির মতো ঘটনা ঘটছে।
বর্জ্য সংগ্রহের সময় তারা সবসময়ই নুয়ে বর্জ্য সংগ্রহ করে এতে মেরুদন্ডের ও ঘাড়ের চাপে ভোগে তারা। পঁচা দুর্গন্ধের মধ্যে কাজ করায় শরীরের সবখানে ব্যথা, বমি বমি ভাব মাথা ঘুড়ানোসহ অনেক ধরনের অস্বস্তিতে ভোগে তারা। ফলে, একদিন কাজ করলে তিন দিন বিশ্রাম নিতে হয় তাদের। শুধু তাই নয় খালি পায়ে কাজ করে বলে চর্ম রোগ লেগেই থাকে এসব মানুষের।
চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞ ডা: এম এন হুদা বলেন, দীর্ঘক্ষণ বর্জ্য সংগ্রহের কাজে যারা নিয়োজিত থাকছে তারা সবসময়ই কোন না কোন চর্ম রোগ যেমনঃ একজিমা, চুলকানি, ফুসকুড়ি, দাউদ ও ফাঙ্গাস জাতীয় চর্মরোগে ভুগছে। তাই দেরি না করে সবাইকে ডাক্তারের শরনাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন এ বিশেষজ্ঞ।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ঢাকা শহরেই প্রায় দেড়লাখ দরিদ্র মানুষ ফেলে দেয়া বর্জ্যসামগ্রী পুনঃব্যবহার করে থাকে যার মূল্য বছরে প্রায় এক হাজার ৭১ কোটি টাকা।
আর্ন্তজাতিক সংস্থা উইমেন ইন ইনফরমাল এমপ্লয়মেন্ট গে¬াবালাইজিং এন্ড অর্গানাইজিং-এর মতে, বর্জ্য সংগ্রহকারীরা জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তা এবং টেকসই পরিবেশ উন্নয়নে উল্লে¬খযোগ্য ভূমিকা রেখে থাকে। তবে তারা সর্বদাই নিম্নশ্রেনীর সামাজিক মর্যাদা লাভের পাশাপাশি নিম্ন মানের জীবন যাপন করে থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বাস্থ্য হচ্ছে শারিরিক, মানসিক, সামাজিক কল্যাণকর পরিস্থিতি, যা শুধু অসুস্থতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটা মানব উন্নয়ন সূচকের একটি অন্যতম মাপকাঠি। তাই, প্রতিটি নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সুস্বাস্থ্যের সুযোগ প্রাপ্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও সবচেয়ে বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন উপেক্ষা করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এসডিজি-৩ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন অপরাজেয় বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু বলেন, নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠী যারা বস্তি বা ফুটপাতে বসবাস করে তারা স্বাস্থ্য পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা থেকে বঞ্চিত। এতে প্রতিনিয়তই বঞ্চনার স্বীকার হচ্ছে অনগ্রসর এ জনগোষ্ঠী। এ থেকে পরিত্রাণে শিশুবান্ধব সহায়ক কার্যক্রম বাস্তবায়ন জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক ঘোষণা ও চুক্তিনামায় অন্যতম স্বাক্ষরকারী দেশ। এর মধ্যে রয়েছে সবার জন্য স্বাস্থ্য বিষয়ক আলমা আতা ঘোষণা, সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি, নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ বিষয়ক সনদ, শিশু অধিকার সনদ। বাংলাদেশ এসব চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। এছাড়াও বাংলাদেশ ২০৩০ সাল নাগাদ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিষয়ে দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি বাস্তবায়ন জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৬ তে বলা হয়েছে যে, শিশু শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্য পুষ্টি শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে এবং ১৮ বছরের নীচে সকল শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে বিরত রাখতে ও যৌন নির্যাতন থেকে মুক্ত রাখতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের ভিশন-২০২১ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের একটি বৃহৎ রূপকল্প। এই রূপকল্পের অধীনে জনগণের তথা দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নয়নের একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছে যেখানে দেশের খাদ্য ঘাটতি কমিয়ে শতকরা ৮৫ ভাগ জনগোষ্ঠীর পুষ্টি নিশ্চিত করা হবে। সেইসাথে সংক্রামক রোগ নির্মুল করা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা ও পয়ঃনিষ্কাষণ সুবিধা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১-এর অন্যতম মূল নীতি হিসেবে বলা হয়েছে যে, স্বাস্থ্যসমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সুবিধা বঞ্চিত গরিব, প্রান্তিক, বয়স্ক, শারিরিক, ও মানসিক প্রতিবন্ধী জনগণের অধিক গুরুত্বপূর্র্ণ স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া।
বর্জজীবীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশের সংবিধান স্বাস্থ্যনীতি ২০১১ ও জাতীয় নগর স্বাস্থ্য কৌশল ২০১৪-তে উল্লেখিত নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য ও সেবার অধিকার বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। বর্জ্যজীবীদের জন্য শিগগিরই সরকারের বিশেষ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কমর্সূচি প্রনয়ন ও তা বাস্তবায়ন প্রয়োজন। তবেই নিশ্চিত হবে বর্জ্যজীবী শিশুর পরিপূর্ণ শারিরিক, সামাজিক ও মানসিক বিকাশ।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: