
ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনাগুলোয় শুক্রবার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। এতে ইরানের বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। ইসরাইলের হামলার পর ইরানও ইসরাইলে পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছে।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর ওপর ইসরাইলের এই হামলা ‘যত দিন প্রয়োজন’ তত দিন স্থায়ী হবে।
তিনি ইসরাইলি গোয়েন্দা তথ্যের বরাত দিয়ে বলেছেন, তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে প্রত্যাবর্তনের আর কোনও সম্ভাবনা নেই।
জেরুজালেম থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি একথা জানিয়েছে।
এদিকে ইসরাইলের বিমান হামলাকে ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ বলে অভিহিত করেছে ইরান। শুক্রবার ও শনিবার ইসরাইলে কয়েক ডজন ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে ইরান।
মধ্যপ্রাচ্য আরও বিস্তৃত সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারে বলে আশঙ্কা বৃদ্ধি পাওয়ায় আন্তর্জাতিক মহল থেকে উভয়পক্ষকে সংযমের আহ্বান জানানো হচ্ছে।
আমরা যা জানি তা হল:
-পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত-
ইরানের ছুটি ও প্রার্থনার দিন শুক্রবার ভোরে ইসরাইলের হামলা শুরু হয় এবং দিনভর বিভিন্ন স্থানে এ হামলা অব্যাহত থাকে।
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানায়, ইসরাইলে অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল নাতানজে। ভূগর্ভস্থ এইবিশাল পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরাইল বেশ কয়েকবার আঘাত হেনেছে।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)’র প্রধান রাফায়েল গ্রোসি বলেন, স্থাপনার বাইরে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা ‘অপরিবর্তিত’ রয়েছে।
ইরান জানিয়েছে যে তাদের ফোরডো ও ইসফাহান পারমাণবিক স্থাপনার সীমিত ক্ষতি হয়েছে।
- কমান্ডাররা নিহত -
নিহতদের মধ্যে ইরানের বিপ্লবী গার্ডের প্রধান হোসেইন সালামি ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ বাগেরি রয়েছেন। সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনি দ্রুত তাদের স্থলাভিষিক্ত করার জন্য নতুনদের নাম ঘোষণা করেছেন।
বিপ্লবী গার্ড জানিয়েছে, তাদের মহাকাশ কমান্ডার আমিরালি হাজিজাদেহও নিহত হয়েছেন। তিনি ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন।
ইরানি গণমাধ্যম জানিয়েছে, এ হামলায় বেশ কয়েকজন পরমানু বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন।
জাতিসংঘে ইরানের রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন, ইসরাইলের প্রথম দফা হামলায় ৭৮ জন নিহত ও ৩২০ জন আহত হয়েছেন।
-চলমান হামলা -
রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ইরনা জানিয়েছে, ইরানের উত্তর-পশ্চিম পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে উপর্যুপরি হামলা চালানো হয়েছে। এতে ১৮ জন নিহত হয়েছে।
একজন ইসরাইলি সামরিক মুখপাত্র বলেছেন, পারমাণবিক স্থাপনা ও বিমান ঘাঁটিসহ ‘দুই শতাধিক লক্ষ্যবস্তুতে’ আঘাত করা হয়েছে।
নেতানিয়াহুর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জাচি হানেগবি বলেছেন, খামেনি ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের ‘হত্যা করার কোনও পরিকল্পনা’ বর্তমানে নেই।
ইরান জুড়ে ইন্টারনেট নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
দেশটির যোগাযোগ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে’ এসব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে।
- ইরানের প্রতিক্রিয়া-
ইসরাইলকে লক্ষ্য করে ইরানের ছোড়া ১০০টি ড্রোনের ‘বেশিরভাগ’ ইসরাইলি ভূখণ্ডের বাইরেই প্রতিহত করা হয়েছে- ইসরাইলি সেনাবাহিনীর এমন দাবির কয়েক ঘন্টা পরেই ইরানের বিপ্লবী গার্ড ও ইসরাইল জানায়, ইসরাইলে কয়েক ডজন ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে ইরান।
দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানায়, শনিবার ভোরে, ইরান নতুন করে আক্রমণ শুরু করেছে।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী বিমান হামলার সাইরেন বাজিয়েছে এবং ইরান থেকে আরও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার খবর দিয়েছে।
ইসরাইল জানিয়েছে যে, তাদের বিমান বাহিনী ‘হুমকি দূর করার জন্য যেখানে প্রয়োজন সেখানে প্রতিহত ও আক্রমণ করার জন্য কাজ করছেন।’
ইসরাইলি উদ্ধারকারীরা শনিবার জানিয়েছেন, তারা দেশের উপকূলে আঘাত হানা রকেট হামলায় আহত ২১ জনকে চিকিৎসা দিচ্ছেন।
ইসরাইলি উদ্ধারকারীদের উদ্ধৃতি দিয়ে ইসরাইলি মিডিয়া রিপোর্টে বলা হয়েছে, এর আগে গুশ দান এলাকায় ৩৪ জন আহত হওয়ার কথা জানিয়েছে, যার মধ্যে একজন নারীও ছিলেন। ওই নারী পরে মারা যান।
- মার্কিন সম্পৃক্ততা? -
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি ইসরাইলি হামলাকে ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ বলে অভিহিত করেছেন এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
তেহরান পূর্বে সতর্ক করে দিয়েছিল যে, সংঘর্ষ হলে তারা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালাবে। ইসরাইলি হামলার কয়েকদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র বেশ কয়েকটি স্থান থেকে অপ্রয়োজনীয় কর্মীদের সরিয়ে নেয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ইসরাইল তাকে আগে থেকেই তাদের অভিযানের বিষয়ে সম্পূর্ণ অবহিত করেছে।
তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, ওয়াশিংটন এই হামলায় জড়িত নয়।
তিনি ইরানকে সতর্ক করে বলেন ‘পরবর্তী পরিকল্পিত আক্রমণ’ ‘আরও নৃশংস’ হবে এবং তেহরানের উচিত ‘কিছুই অবশিষ্ট না থাকার আগেই’ তার পারমাণবিক কর্মসূচি প্রত্যাহারের জন্য একটি চুক্তি বাতিল করা।
ট্রাম্প বারবার উচ্চারন করেন যে, তিনি ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরী করতে দেবেন না।
এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থ বা কর্মীদের লক্ষ্যবস্তু না করতে ইরানকে সতর্ক করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও।
- পারমাণবিক কর্মসূচি-
তেহরান দীর্ঘদিন ধরে পারমাণবিক বোমা তৈরির বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে। কিন্তু দেশটি ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে, যা ২০১৫ সালে বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলোর সাথে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে করা ওই চুক্তি অনুযায়ী সেই নির্ধারিত মাত্রা ছিল ৩.৬৭ শতাংশ।
তবে, ইরানের ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধকরণের মাত্রা এখনও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরীর জন্য প্রয়োজনীয় ৯০ শতাংশ সীমার চেয়ে কম।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে কয়েক দফা আলোচনা চালায়। রোববার ওমানে নির্ধারিত পরবর্তী দফার আলোচনাটি এখন বাতিল হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
-বিশ্ব প্রতিক্রিয়া-
ইসরাইল ও ইরানের পাল্টাপাল্টি হামলা আন্তর্জাতিক উদ্বেগকে বাড়িয়ে তুলছে। ইসরাইল-ইরান সংঘাত আরো তীব্র হয়ে উঠলে যদি মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদন ও সরবরাহ প্রভাবিত হয়, তবে এর পরিণতির আশঙ্কায় অনেক দেশ উভয় পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে।
জাতিসংঘের পারমাণবিক শক্তি সংস্থা সোমবার একটি জরুরি বৈঠকের পরিকল্পনা করেছে।
জাতিসংঘের প্রধান আন্তোনিও গুতেরেস ইসরাইল ও ইরানকে তাদের সংঘাত বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘শান্তি ও কূটনীতি অবশ্যই জয়ী হবে।’
ইসরাইল, ইরান, ইরাক, জর্ডান ও সিরিয়া তাদের আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে এবং বেশ কয়েকটি বিমান সংস্থা এই অঞ্চলে পরিষেবা প্রদানকারী ফ্লাইট বাতিল করেছে।
শুক্রবার তেলের দাম অনেক বেড়ে যায়। কিছুটা কমে যাওয়ার আগে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম প্রায় ৭৫ ডলারে পৌঁছে যায়।
বিশ্লেষকরা উপসাগরের সংকীর্ণ হরমুজ প্রণালী দিয়ে বিশ্বের ২০ শতাংশ অপরিশোধিত তেল সরবরাহের ঝুঁকির ওপর জোর দিয়েছেন।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: