ঢাকা | শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫, ১৩ আষাঢ় ১৪৩২

নদীর অধিকার ও আমাদের নৈতিক দায়িত্ব

odhikarpatra | প্রকাশিত: ২৭ জুন ২০২৫ ১৮:৩৯

odhikarpatra
প্রকাশিত: ২৭ জুন ২০২৫ ১৮:৩৯

✍ উপ-সম্পাদকীয়
বাংলাদেশ—এক নদীমাতৃক জনপদ। যে ভূখণ্ডে প্রতি বাঁকে বাঁকে নদীর হাতছানি, যে মাটির স্নায়ুপ্রবাহে নদীর গতি, সেই ভূখণ্ডেই আজ নদী যেন এক নিঃসঙ্গ, নির্বাক আর্তনাদ। নদী আমাদের জন্মদাত্রী, সংস্কৃতির ধারক, কৃষির চালিকাশক্তি, জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়—তবু আজ সে নিজভূমে পরবাসী।
আমাদের সভ্যতার ভিতে যাঁর নাম লেখা, সেই নদীর নেই কোনো স্বীকৃত অধিকার। তার ভূমি কেটে বানানো হয় বস্তি, তার বুকে ফেলা হয় বর্জ্য, আর তার বয়ে চলা ধারা রুদ্ধ হয় লোভের বাঁধে। আমরা নদীকে দেখি শুধু ‘সম্পদ’ হিসেবে—চাষের জমি, ড্রেনেজ ব্যবস্থার পথ বা আবর্জনার গন্তব্য। অথচ নদী কেবল পানি নয়—নদী হচ্ছে প্রাণ, প্রবাহ, প্রাণস্পন্দনের ধারা।
প্রশ্ন জাগে—নদী কি কেবলই পানি বয়ে আনার মাধ্যম? না, নদী নিয়ে আসে সভ্যতা, বয়ে আনে জীবন, বয়ে চলে ইতিহাস। নদী আমাদের জীবনের চিত্রপট, আমাদের ঐতিহ্যের উৎস। তিস্তা, করতোয়া, ছোট যমুনা কিংবা ইছামতির মতো একদা খরস্রোতা নদীগুলো আজ মৃতপ্রায়। সেগুলো এখন নামমাত্র, স্মৃতির আল্পনা মাত্র। কোথাও ধানক্ষেত, কোথাও মরা খাল—নাব্যতা নেই, প্রাণ নেই, প্রবাহ নেই।
নদীরও অধিকার আছে।
কী সেই অধিকার?
• নিজের গতিপথে প্রবাহিত হবার অধিকার
• দূষণমুক্ত পরিবেশে টিকে থাকার অধিকার
• অবৈধ দখলমুক্ত থাকার অধিকার
• প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা ও সংযোগস্থাপনকারী ভূপ্রকৃতি হয়ে উঠার অধিকার
এই অধিকার শুধু পরিবেশগত দায় নয়, এটি নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়। ভারতের উত্তরাখণ্ড হাইকোর্ট যেমন গঙ্গা-যমুনাকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, আমাদেরও সেই সাহসী সিদ্ধান্ত দরকার। কারণ নদী হারানো মানেই ভবিষ্যৎ হারানো।

ইছামতির কথা বলি।
উত্তর বাংলার ইছামতি আজ আর নদী নয়—একটি আক্ষেপের নাম। দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার নশরতপুর, সাতনালা, আলোকডিহির মানুষ এখন আর নদীর প্রবাহ দেখে না, দেখে শুধু ধানক্ষেত। নদীর বুকজুড়ে চাষ হচ্ছে ভুট্টা, রসুন, ধান। মাঝেমধ্যে পানির জন্য বসানো হয় শ্যালোমেশিন। বর্ষায় হঠাৎ নদী জেগে উঠে পাশের ফসল ডুবিয়ে দেয়, আবার শীত এলে সে হয়ে ওঠে ধুলোমাখা স্মৃতি।
এই দৃশ্য শুধু ইছামতির নয়—বাংলাদেশের অসংখ্য নদীর এক অভিন্ন যন্ত্রণা। নদী মরে গেলে মরে কৃষি, মরে জীবিকা, হারায় ঐতিহ্য। মরে যায় ইতিহাস।
নদীর অধিকার নিশ্চিত করা মানে:
• প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে সহায়তা করা
• কৃষির জন্য পানি নিশ্চিত করা
• জলজপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা
• নদীনির্ভর জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষা করা
নদীর কান্না মানে প্রকৃতির নিঃশব্দ অভিশাপ—যা আমরা শুনেও শুনি না। সভা-সেমিনারে নদীর গল্প উঠলেও মাঠপর্যায়ে কাজ হয় না। পরিকল্পনার কথা বলা হয়, কিন্তু তার বাস্তবায়নে থাকে না আন্তরিকতা।
এখন দরকার—
• সাংবিধানিক স্বীকৃতি: নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করা
• আইনগত কাঠামো: নদীর জন্য পৃথক সুরক্ষা আইন প্রণয়ন
• কার্যকর ব্যবস্থাপনা: খনন, অবৈধ দখল উচ্ছেদ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ
• জনসম্পৃক্ততা: নদী রক্ষা আন্দোলনে স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা
আজ সময় এসেছে নতুন এক চেতনায় জেগে উঠার—যেখানে নদী থাকবে মানুষকে ঘিরে নয়, মানুষ থাকবে নদীকে ঘিরে। কারণ নদী মানে শুধু প্রকৃতি নয়, নদী মানে জীবন। নদী মানে ভাষা, গান, চাষ, ঘর, গতি, ইতিহাস।
কবির কণ্ঠে যেমন—
“আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে, কাজে বড় হবে?”
আমরা সে নেতৃত্ব চাই—যে শুধু কথায় নয়, কাজে নদীর অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করবে।
আমরা সে রাষ্ট্র চাই—যে শুধু ড্রেজিং নয়, নদীর সঙ্গে জীবন-সম্পর্ক গড়ে তুলবে।
আমরা সে জনতা চাই—যারা নদীর কান্না শুনবে, নদীর অধিকারকে আপন করে নেবে।
পরিশেষে বলি—নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে। নদী শুধু গতির ধারাই নয়, সে আমাদের অস্তিত্বের প্রবাহ। নদীর অধিকার প্রতিষ্ঠাই হোক আমাদের আগামী প্রজন্মের প্রতি আমাদের সবচেয়ে বড় অঙ্গীকার।

অধ‍্যাাপক ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: