ঢাকা | সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫, ১৫ আষাঢ় ১৪৩২

শুধু কাগুজে ডিগ্রি নয়, প্রয়োজন বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণ: জাতীয় উন্নয়ন কারিগরি শিক্ষা সংস্কারে দৃষ্টিভঙ্গির সংকট

odhikarpatra | প্রকাশিত: ২৯ জুন ২০২৫ ২০:১২

odhikarpatra
প্রকাশিত: ২৯ জুন ২০২৫ ২০:১২

কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ (TVET)-এর আলোয় উজ্জ্বল হোক সম্ভাবনার বাংলাদেশ।

আজকের বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে হাঁটছে। এই যাত্রায় সবচেয়ে বড় সম্পদ আমাদের বিপুল জনশক্তি। এই মানবসম্পদকে দক্ষতায় রূপান্তর করার অন্যতম প্রধান উপায় হচ্ছে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ—TVET। কিন্তু এই সম্ভাবনাময় পথটি এখনো পর্যাপ্ত মনোযোগ ও বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত। বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বপ্ন বাস্তবায়নে TVET-এর অবদান অপরিহার্য, তবে তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গির সংকটে।
১. কর্মসংস্থান ও অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে TVET: TVET শুধুমাত্র শিক্ষার বিকল্প পথ নয়; এটি শিল্প ও সেবা খাতে দক্ষ কর্মী সরবরাহের মাধ্যমে অর্থনীতির শক্তি বৃদ্ধি করে। যুব সমাজের জন্য এটি স্বনির্ভরতা অর্জনের একটি কার্যকর উপায়। বাস্তবভিত্তিক প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকেই আজ ক্ষুদ্র উদ্যোগ শুরু করছেন, যা দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
২. আন্তর্জাতিক বাজার ও প্রস্তুতির ঘাটতি: জাপানের মতো দেশে দক্ষ কর্মী পাঠানোর বিরাট সুযোগ থাকলেও, বাংলাদেশের প্রস্তুতি এখনো দুর্বল। বিএমইটি’র এক কর্মকর্তা আক্ষেপ করে বলেছেন, “জাপানে ৫ বছরে ৫ লাখ দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে না পারার আশঙ্কা রয়েছে।” ভাষা দক্ষতা, প্রযুক্তিগত মান ও প্রশিক্ষণ কাঠামোর দুর্বলতা এই চুক্তিগুলো বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
৩. অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও গুণগত ঘাটতি: প্রায় ৮ হাজার কারিগরি প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও ল্যাব, যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান কার্যকর প্রশিক্ষণ দিতে পারছে না। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত যেমন ১:১৪৪—এটি দক্ষতা বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুতর সংকেত। অনেক প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী ক্যাম্পাস না থাকায় পাঠদান চলছে ভাড়াকৃত ভবনে, যা শিক্ষার পরিবেশকে বাধাগ্রস্ত করছে।
৪. আন্তর্জাতিক তুলনা: কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ?: দক্ষিণ কোরিয়ায় ৯৫%, জার্মানিতে ৭৫% এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৫২% যুবকরা TVET-এ অংশগ্রহণ করছে; বাংলাদেশে এ হার মাত্র ২০%। অথচ ২০৩০ সালের মধ্যে তা ৩০% এবং ২০৫০-এর মধ্যে ৫০%-এ উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। লক্ষ্য মহৎ, তবে বাস্তবায়নে নেই কাঠামোগত গতি।
৫. চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ ও প্রস্তুতি: রোবোটিক্স, এআই, আইওটি, ভার্চুয়াল রিয়ালিটি—এই প্রযুক্তি গুলো শিল্পক্ষেত্রে প্রবেশ করছে, যা TVET-কে যুগোপযোগী রূপে রূপান্তরের দাবি জানায়। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে দক্ষতাহীন যুবশক্তি কর্মসংস্থান থেকে ছিটকে পড়বে।
৬. নীতিমালা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: সরকার বেশ কিছু প্রকল্প চালু করেছে—যেমন ৬৪টি কারিগরি কলেজে উন্নয়ন, “School in Cloud” চালুর উদ্যোগ। কিন্তু এ প্রকল্পগুলো নিরবচ্ছিন্ন বাস্তবায়ন এবং মনিটরিং ছাড়া সফল হবে না। বাজেট বরাদ্দ, সরকারি-বেসরকারি সমন্বয়, এবং মাননিয়ন্ত্রণ সেল গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে।
৭. দরিদ্রতা বিমোচন ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি: TVET শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠারও হাতিয়ার। নিন্মআয়ের পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপ, সহজ ঋণ, এবং লিঙ্গ-সংবেদনশীল ট্রেডে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াতে কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন।
৮. শিল্প-শিক্ষা সংযুক্তি ও বাস্তবভিত্তিক শিক্ষা: শুধু কাগুজে ডিগ্রি নয়, প্রয়োজন বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণ। এজন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে মেলবন্ধন অত্যন্ত জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রযুক্তিগত ও ডিজিটাল স্কিল প্রশিক্ষণ চালু হলে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি উদ্যোক্তা তৈরিতেও অবদান রাখা সম্ভব।
৯. ভবিষ্যৎ নির্দেশনা
• একাদশ শ্রেণিতে চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা চালুর প্রস্তাব বিবেচনাধীন।
• ৫জি নেটওয়ার্কসহ শক্তিশালী কানেক্টিভিটি নিশ্চিত করে ক্লাউড-ভিত্তিক প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণের সম্ভাবনা রয়েছে।
• নিউরোটেক, জেনেটেকসহ অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ চালুর প্রস্তুতি TVET-কে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, দারিদ্র্য বিমোচন, শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, ও ডিজিটাল বাংলাদেশ—সবকিছুর কেন্দ্রে রয়েছে দক্ষ মানবসম্পদ। আর সেই দক্ষতা অর্জনের প্রধান সেতু হলো TVET। কিন্তু অব্যবস্থাপনা, দৃষ্টিভঙ্গির সংকট ও গুণগত ঘাটতির কারণে এই পথ আজও অনেকাংশে অবহেলিত।
সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন:
• বাজেট ও অবকাঠামোতে সুদৃঢ় বিনিয়োগ,
• দক্ষ প্রশিক্ষক গড়ে তোলা ও যুগোপযোগী কারিকুলাম,
• শিল্প-শিক্ষা সমন্বয়ের মাধ্যমে বাস্তবমুখী শিক্ষা নিশ্চিতকরণ,
• সামাজিক ও বৈদেশিক চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা প্রশিক্ষণ।
“TVET মানেই কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ”—এই বার্তা শুধু স্লোগান নয়, উন্নয়ন দর্শনের মূল ভিত্তি হওয়া উচিত। দক্ষতা অর্জনের আলোয় আলোকিত হোক প্রতিটি যুবক-যুবতী, গড়ে উঠুক আত্মপ্রত্যয়ী বাংলাদেশ।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: