ঢাকা | রবিবার, ১৭ আগস্ট ২০২৫, ১ ভাদ্র ১৪৩২
বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিরতায় শ্রীকৃষ্ণ ও তার শিক্ষা

অন্যায়ের অন্ধকারে ন্যায়ের বাঁশি

odhikarpatra | প্রকাশিত: ১৭ আগস্ট ২০২৫ ০১:০১

odhikarpatra
প্রকাশিত: ১৭ আগস্ট ২০২৫ ০১:০১

বিশেষ প্রতিবেদন

[বি:দ্র: “জন্মাষ্টমীর শুভক্ষণে সনাতন ধর্মাবলম্বী সকল ভাই-বোনকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ অধিকারপত্র এই লেখাটি উৎসর্গ করছে।”]

গতকাল ১৬ আগস্ট সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান জন্মাষ্টমী পালিত হয়েছে, যা আবহমান বাংলার ঐতিহ্য হিসেবে যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে। কিন্তু জাকজমকপূর্ণ আয়োজনের মধ্যেই যেন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে আমাদের চর্চা। র‍্যালীতে আগত কয়েকজনকে যখন প্রশ্ন করা হলো—“আজকে কেন এসেছেন?”—তাদের সহজ উত্তর ছিল, ভগবান কৃষ্ণের জন্মদিন পালন করতে, এতে ভগবান তুষ্ট হবেন, পুণ্য হবে কিন্তু ভগবানের শিক্ষা জীবনে কীভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন—এই প্রশ্নে প্রায় সবাই ছিলেন অস্পষ্ট।এসময় একজন পুরোহিত শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব প্রসঙ্গে সুন্দরভাবে বললেন—“যখন ধর্মের গ্লানি হয় ও অধর্মের উত্থান ঘটে, তখন ভগবান জগতে আবির্ভূত হয়ে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করেন। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথির পুণ্যলগ্নে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হন। অষ্টমী তিথিতে জন্ম নেয়ায় এই দিনটি জন্মাষ্টমী নামে পরিচিত।

তবে শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষার ব্যবহারিক উপযোগিতা প্রসঙ্গে সাধারণ মানুষের উপলব্ধি খুব সীমিত। অথচ, প্রেম ও ভালোবাসার শক্তি যে অস্ত্রের চেয়েও প্রবল—তা শ্রীকৃষ্ণই আমাদের শিখিয়েছেন। তাঁর অমোঘ বাণী বর্তমান পরিবর্তনশীল সমাজেও শান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর হতে পারে, যদি তা বাস্তবে প্রয়োগ করা যায়। যেমন তিনি বলেছেন—শক্তি প্রয়োগে শান্তি অর্জন করা যায় না; কেবল বোঝাপড়ার মাধ্যমে তা সম্ভব।”

ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যে জ্ঞান দান করেছেন, তা কেবল ধর্মীয় গ্রন্থ নয়; বরং মানবতা প্রতিষ্ঠার এক দিকনির্দেশক দলিল। কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞান—এই তিন পথ অনুসরণ করলে জীবনের পরম লক্ষ্য অর্জন সহজ হয়। আজ আমরা পাশ্চাত্য দর্শনে মগ্ন থাকলেও, নিজেদের মাটির কাছের এই চিরন্তন জ্ঞানকে অবহেলা করছি। অথচ শ্রীকৃষ্ণ তাঁর জীবন থেকেই শিক্ষার উপলক্ষ তৈরি করেছেন।

রাষ্ট্রপ্রধান, শিক্ষক বা অভিভাবকের দায়িত্ব প্রসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন (গীতা ৩.২১): শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যেভাবে আচরণ করেন, সাধারণ মানুষ তাঁর অনুকরণ করে। তিনি যা গ্রহণ করেন, সমগ্র পৃথিবী তাই অনুসরণ করে।” এ শিক্ষার আলোকে একটি দায়িত্বশীল সমাজ ও নৈতিক রাষ্ট্র গড়ে ওঠা সম্ভব।

বর্তমান সমাজে বৈষম্য, দুর্নীতি ও অশান্তির প্রেক্ষাপটে শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সত্য, কর্তব্য ও মানবিকতার উপর দাঁড়িয়েই টেকসই সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। জন্মাষ্টমীর উৎসব কেবল ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি হওয়া উচিত নৈতিকতা, শান্তি, ভ্রাতৃত্ববোধ ও নেতৃত্বের চর্চার উপলক্ষ। শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা যদি ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে প্রয়োগ করা যায়, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ হবে আরও আলোকিত, শান্তিময় ও মানবিক।

বর্তমান সময়েও শ্রীকৃষ্ণের বাণী অনেককে শান্তি দেয়, জীবনের পরিস্থিতি মেনে নিতে সহায়তা করে। তিনি বলেছেন—যা কিছু ঘটেছে, ভালোর জন্যই ঘটেছে। যা কিছু ঘটছে, ভালোর জন্যই ঘটছে।”

অপরদিকে জীবন সম্পর্কে তিনি স্পষ্ট করে বলেন—একজন ব্যক্তির কর্তব্যই তার ধর্ম।” ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন—হে পার্থ, যিনি ধর্মের পথে চলেন, তাঁকে কখনোই ধ্বংস করা যায় না; না তিনি ইহজগতে, আর না পরজগতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হন। হে আমার প্রিয় বন্ধু, যাঁর মধ্যে ঈশ্বরের অনুভূতি জেগেছে, তিনি কখনোই কোনও অন্যায় বা অশুভ শক্তির কাছে পরাজয় স্বীকার করেন না।”

জীবনে উন্নতির সর্বশ্রেষ্ঠ পথ হল নিজেকে উন্নত করা। নিজেকে চেনা এবং অন্তরাত্মাকে জাগিয়ে তোলার মাধ্যমেই লক্ষ্যের দিকে এগোনো সম্ভব। জীবনকে ইতিবাচকভাবে নিতে হলে বিষণ্ণতাকে জয় করতে হবে। এ প্রসঙ্গে কৃষ্ণ বলেছেন, মনের রূপান্তরের মাধ্যমে বিষণ্ণতা কাটিয়ে ওঠা সহজ হয়। তাঁর বাণী—যে ব্যক্তি মনকে জয় করেছে, তার মনই সবচেয়ে বড় বন্ধু; আর যে তা করতে ব্যর্থ হয়েছে, তার মনই তার সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে থাকে।” (ভগবদ্গীতা ৬.৬)

বর্তমান অস্থির সময়ে তাঁর বাণীর সাথে এক অদ্ভুত মিল খুঁজে পাই। তিনি বলেছেন—আমরা অশান্ত সময়ের মধ্যে বাস করি। প্রায়শই ভবিষ্যৎ অজানা থাকে; তাই, অনিশ্চয়তার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া আমাদের কর্তব্য। যখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আসে, তখন প্রস্তুতির সময় শেষ হয়ে যায়।”

তাই বলা যায়, বাংলাদেশের বহুধর্মীয় সমাজে শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা পারস্পরিক সম্প্রীতি, সহনশীলতা ও নৈতিকতার বীজ বপন করতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁর দর্শনের অন্তর্ভুক্তি শিক্ষার্থীদের শুধু জ্ঞানী নয়, বরং মূল্যবোধসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।

পরিশেষে বলা যায়—শ্রীকৃষ্ণ কেবল পুরাণের চরিত্র নন; তিনি যুগে যুগে ন্যায়, কর্তব্য ও মানবিকতার দিশারি। ভগবদ্গীতার আলোচনায় তিনি যে শিক্ষা দিয়েছেন, তা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। কর্মে নিষ্ঠা, ন্যায়পথে স্থিতি এবং মানবিকতার আহ্বান—এসব শিক্ষাই আজকের সংকটময় সময়ে দিকনির্দেশক হতে পারে।

তাই সনাতন ধর্মাবলম্বী ভাইবোনদের প্রতি আহ্বান থাকবে—শ্রীকৃষ্ণকে কেবল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, তাঁর আদর্শকে সমাজে ছড়িয়ে দিতে হবে। শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে তাঁকে কাজে লাগাতে হবে। কারণ তিনি এক অনন্ত দর্শনের আলো। সত্য, কর্তব্য ও মানবিকতার উপর দাঁড়িয়ে টেকসই সমাজ গড়ার দিশা তাঁর শিক্ষা আজও দেয়। বর্তমান যুগে শ্রীকৃষ্ণের দর্শনকে কেবল আধ্যাত্মিকতা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় নীতি, নেতৃত্ব, সামাজিক ন্যায়বিচার ও ব্যক্তিজীবনের দিশারি হিসেবে গ্রহণ করা প্রয়োজন।

-অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান লিটু, উপদেষ্টা সম্পাদক



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: