বিশেষ লেখা | বিশ্লেষণ
প্রতিবেদন: বিশেষ প্রতিনিধি, অধিকার পত্র ডটকম
বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘ সময় পর ভোটাধিকার প্রয়োগের সম্ভাবনায় মানুষের মধ্যে যেমন প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, তেমনি সমানতালে বেড়েছে শঙ্কা ও অস্থিরতা। এই প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক সহিংসতা ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া আবারও স্পষ্ট করে দিয়েছে—যখন জাতির সবচেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা, ঠিক তখনই বিভাজন সবচেয়ে প্রকট হয়ে উঠছে।
জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উঠে আসা তরুণ নেতা ও সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থী ওসমান হাদির ওপর প্রকাশ্য হামলা এবং হত্যাচেষ্টার ঘটনায় দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে দোষীদের গ্রেপ্তার ও বিচার নিশ্চিত করার দাবি উঠলেও, ঘটনার পরবর্তী রাজনৈতিক বক্তব্য ও পাল্টা অবস্থান জাতিকে আরও বিভক্ত করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিভাজন নতুন কিছু নয়; তবে কিছু ঐতিহাসিক প্রশ্নে জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই। মুক্তিযুদ্ধ ও ১৯৭১ সেই প্রশ্নগুলোর অন্যতম। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দলীয় অবদান নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, পাকিস্তানি শাসনের দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দমননীতিই যে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি করেছিল—এ বিষয়ে জাতীয়ভাবে ঐকমত্য থাকার কথা।
শহীদের সংখ্যা বা ইতিহাসের নানা দিক নিয়ে গবেষণা ও বিতর্ক প্রয়োজন—এতে দ্বিমত নেই। কিন্তু সেই আলোচনা কি মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক বাস্তবতা অস্বীকারের দিকে যাচ্ছে? এই প্রশ্নই এখন নতুন করে সামনে আসছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিভাজনের একটি বড় কারণ হলো—গত দেড় দশকে মুক্তিযুদ্ধকে রাজনৈতিক বৈধতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা। এর ফলে যুদ্ধের নৈতিক মর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শব্দবন্ধটি অনেকের কাছে বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়েও নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ইতিহাসচর্চার ধরন। দীর্ঘদিন ধরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রধানত রাষ্ট্রবাদী ও দলকেন্দ্রিক বয়ানে সীমাবদ্ধ ছিল। ফলে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ, স্থানীয় অভিজ্ঞতা এবং বহুমাত্রিক নেতৃত্বের ভূমিকা মূলধারার আলোচনায় জায়গা পায়নি। এতে করে মুক্তিযুদ্ধ অনেকের কাছে জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন একটি রাজনৈতিক বয়ানে পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা ও দায় স্বীকারের বিষয়টিও অমীমাংসিত থেকে গেছে। পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতার অভিযোগে অভিযুক্ত নেতাদের বিষয়ে দলীয়ভাবে স্পষ্ট ও গ্রহণযোগ্য অবস্থান না নেওয়ায় আস্থার সংকট রয়ে গেছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, দায় স্বীকার ও আত্মসমালোচনা ছাড়া জাতীয় পুনর্মিলন সম্ভব নয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষণে উঠে আসে আরেকটি বাস্তবতা—বিচারহীনতা একদিকে যেমন অপরাধকে উৎসাহিত করে, অন্যদিকে ভুক্তভোগী ও অভিযুক্ত—দুই পক্ষকেই দীর্ঘমেয়াদি সংকটে ফেলে। অতীতের দায় এড়িয়ে বর্তমানের ভিকটিম পরিচয় গ্রহণ করলেও ইতিহাসের প্রশ্ন এড়ানো যায় না।
বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত—মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খোলামেলা গবেষণা, সমালোচনামূলক আলোচনা ও সত্যনিষ্ঠ ইতিহাসচর্চা জরুরি। তবে সেই প্রক্রিয়া যেন ইতিহাস অস্বীকার বা বিকৃতির পথে না যায়, সেদিকেও সতর্ক থাকতে হবে। জাতীয় ঐক্য গঠনের জন্য অতীতের মুখোমুখি হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।
প্রথমআলো

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: