
আমাদের দেশের স্বাস্থ্যসূচকে নারীদের অবস্থান এখনও বেশ দুর্বল। তাই স্বাস্থ্যে সকলের সমান অধিকারের বিষয়টি কতটা ছোঁয়া সম্ভব হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে গেছে। একে ছুঁতে গেলে আরও একটি সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজন।
ভারতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে মহিলাদের অবস্থানের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। তা সত্ত্বেও স্বাস্থ্যসূচকের নিরিখে পুরুষদের তুলনায় মহিলারা অনেকটাই দুর্বল অবস্থানে। প্রতিটি সরকার এই পরিস্থিতিকে স্বীকৃতি দিয়ে ধারাবাহিক ভাবে মহিলাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নানা কর্মসূচি নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন। যে প্রকল্পে মূলত মহিলাদের গর্ভাবস্থা, প্রসব এবং প্রসব পরবর্তী চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। পরিবার পরিকল্পনা প্রকল্পে মূলত মহিলাদের গর্ভনিরোধক এবং তার স্বাস্থ্যের বিষয়ে সহায়তা করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া জনসাধারণের জন্য নেওয়া একাধিক প্রকল্পেরও লক্ষ্য নারীর স্বাস্থ্য।
তৎসত্ত্বেও সমাজভিত্তিক কর্মসূচিগুলি থেকে প্রমাণিত, সরাসরি চিকিৎসাগত হস্তক্ষেপে নয়, নারীর স্বাস্থ্যের অনেক বেশি উন্নতি ঘটে অর্থনৈতিক উন্নয়নে। তাই এ ধরনের কর্মসূচিগুলির মূল লক্ষ্য হল মহিলাদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থান। এ দু’টি ক্ষেত্রে দেশব্যাপী অভিযানের (সর্বশিক্ষা অভিযান ও জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প) মূল লক্ষ্য হল বালিকা ও নারীরা। স্বনির্ভর প্রকল্প, ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প যেমন মহিলাদের দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে, তেমনই জীবনধারণের বিকল্প পথ দেখিয়ে তাদের আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর করে নিজস্ব সম্পদ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে।
নারীর অবস্থার সূচক
জাতীয় তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে দেশে মাতৃত্বকালীন মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমশ কমছে। অন্য দিকে সদ্যোজাতের স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সূচকের ক্ষেত্রেও উন্নতি ঘটছে। কিন্তু অনেক সূচকের ক্ষেত্রেই লিঙ্গ বৈষম্য রয়েছে। জন্ম হওয়ার আগেই মৃত্যু, সদ্যোজাতের মৃত্যু এবং পাঁচ বছর হওয়ার আগে মেয়েদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার বেশি। কন্যাভ্রূণ হত্যা এবং শিশুকন্যা হত্যার দৃষ্টান্ত তো রয়েছেই। অসুস্থ হলে বা অপুষ্টিতে ভুগলে শিশুপুত্রের তুলনায় শিশুকন্যাকে অনেক দেরিতে হাসপাতালে আনা হয়। কন্যার জন্ম দেওয়া এবং পুত্রের জন্ম দিতে না পারা অনেক সময়েই মেয়েদের প্রসব-পরবর্তী বিষণ্ণতার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর পাশাপাশি নানা সামাজিক কারণে বাড়ছে আত্মহত্যা। উল্লেখযোগ্য ভাবে যুবকদের থেকে যুবতীদের আত্মহত্যার হার তিন গুণ বেশি। মহিলা ও বালিকাদের উপর হিংসা আজকাল একটি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্কুলে নাম লেখানো, উপস্থিতি এবং সাক্ষরতার হার মহিলাদের মধ্যে যথেষ্ঠ কম। এ সব ক্ষেত্রে মহিলাদের হার কম হওয়ার বেশ কিছু কারণ আছে। এলাকা থেকে স্কুল দূরে হওয়ার কারণে অনেকেই দীর্ঘ পথে পরিয়ে স্কুলে যেতে ভয় পায়। স্কুলে মেয়েদের জন্য আলাদা বাথরুমের অভাব। আছে শিক্ষিকার স্বল্পতা। এর সঙ্গে শিশুকন্যাকে দুয়োরানি করে রাখার ব্যাপারটা তো আছেই।
নারীর সামাজিক অবমূল্যায়ন
মেয়েরা ঘরের কাজ করে। তাই তাদের কাজকে কোনও গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অথচ এক জন মেয়ে প্রতি দিন একজন পুরুষের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি পরিশ্রম করে। প্রযুক্তির উন্নতি ও বাজার অর্থনীতি মহিলাদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাদের কর্মসংস্থান হচ্ছে না, কারণ তারা অদক্ষ এবং অশিক্ষিত। আবার একই সময় ধরে খেটেও পুরুষের চেয়ে কম মজুরি পাচ্ছে মহিলা এবং শিশু মেয়ে শ্রমিকরা। কর্মরত মহিলারা নানা ভাবে সামাজিক বৈষম্য ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির শিকার হন। যার মধ্যে রয়েছে যৌন হেনস্থা। মেয়েদের কাজকে সামাজিক ভাবে খুব গুরুত্বহীন করে দেখা হয়। পরিবারে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাধিকার খুব কম মেয়েরই থাকে।
লিঙ্গসমতা এবং ন্যায়বিচার রাষ্ট্রপুঞ্জের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের (ইউএনএমডিজি) অন্যতম। কিন্তু ভারতে এর প্রয়োগ খুবই ধীর গতিতে হচ্ছে। লিঙ্গসমতা সংক্রান্ত বিষয়গুলিকে ভারতে মূল সমস্যা বলে ধরা হচ্ছে না। উন্নয়নের অংশীদার হওয়ার বদলে মহিলারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর শিকার হয়ে যাচ্ছেন। মহিলাদের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতটি বিবেচনার মধ্যে আনাই হচ্ছে না।
লিঙ্গভিত্তিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যের গুরুত্ব
সাধারণ ভাবে সমাজ-সংস্কৃতির প্রেক্ষিতেই এবং সামাজিক প্রথার নিরিখে লিঙ্গ ন্যায়বিচারের প্রসঙ্গটি ভাবা হয়। মহিলাদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য বিচার করলেই লিঙ্গের গুরুত্ব এবং মহিলাদের স্বাস্থ্যের উপর তার কী প্রভাব পড়ে তা বোঝা যায়। ভারতে মহিলারা সব চেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার। এর ফলে তাঁরা শুধু বিরূপ সামাজিক অবস্থানেই থাকেন না, স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও তাঁরা পিছিয়ে থাকেন।
সামাজিক নির্ধারকগুলি মহিলা এবং শিশুকন্যাদের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে। মহিলাদের স্বাস্থ্য সমস্যাকে সাধারণ ভাবে এক জন ব্যক্তিবিশেষের স্বাস্থ্যসমস্যা হিসেবে দেখে এবং সমাধানের জন্য ব্যক্তিগত ভাবে চিকিৎসা করার পরামর্শ দিলে, বিষয়টিকে লঘু করে দেখা হবে। নারী সংক্রান্ত জনস্বাস্থ্যের বিষয়টিকে চিকিৎসাশাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনে একটা বড় খামতি থেকে যায়। স্বাস্থ্য ও নিবারণ সংক্রান্ত সমস্ত কর্মসূচির মূলে থাকা উচিত সামাজিক দৃষ্টিকোণ কারণ ব্যক্তিগত চিকিৎসা-সমাধান জনস্বাস্থ্যের উপর সামান্যই প্রভাব ফেলে।
কার্যকরী ব্যবস্থার পথে বাধা
স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক ন্যায়বিচার করা এবং লিঙ্গ অসমতা দূর করার পথে বাধা সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয়গুলি। নারীদের প্রতি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যভিত্তিক যে সুপরিকল্পিত বৈষম্য করা হয়, চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যবস্থা থেকে সুফল পেতে হলে সেই বৈষম্য দূর করা দরকার। সুপ্ত হলেও চিকিৎসা এবং ফলাফলের উপর লিঙ্গ ও সংস্কৃতি গুরুতর প্রভাব ফেলে। লিঙ্গ ও সংস্কৃতির মধ্যে যে সম্পর্ক রয়েছে তা বোঝা এবং এ সংক্রান্ত বিষয়গুলি মোকাবিলার সাফল্য অথবা ব্যর্থতার উপর মহিলাদের স্বাস্থ্যসূচক অনেকটা নির্ভরশীল। লিঙ্গবৈষম্যের বিষয়টি আমাদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির মধ্যে দৃঢ় ভাবে প্রোথিত। লিঙ্গসমতা নিয়ে বিতর্ক অনেক সময়েই সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর ধর্ম নিয়ে আলোচনায় পর্যবসিত হয়। নারীদের ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক ন্যায়বিচারের লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে যে বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন, তা নিয়ে আলোচনায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো।
সমাধান কোন পথে
ভারতের সংবিধান মেয়েদের সমানাধিকার এবং আইনী সুরক্ষা নিশ্চিত করে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় সংস্কৃতি চলছে তার নিজের পথে। বহু গবেষক এবং সমাজকর্মী মানতেই চান না যে আমরা নারীদের স্বাস্থ্য ও সমাজে তাঁদের অবস্থার উন্নতি তখনই ঘটাতে পারব যখন সমাজ লিঙ্গবৈষম্যের বিষয়টি খোলাখুলি ভাবে মোকাবিলা করার চেষ্টা করবে। দীর্ঘ সময় ধরে আমরা নারীদের বিষয়গুলি নিয়ে সমাজের সঙ্গে স্পষ্ট আলোচনা এড়িয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সামাজিক বিপ্লব ছাড়া ভারতীয় নারীদের স্বাস্থ্যের উন্নতি কার্যত অধরাই থেকে যাবে।
এ ব্যাপারে অনেক পদ্ধতির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে সামাজিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক বৈষম্যকে জানা-বোঝা এবং তার মুখোমুখি হওয়ার বিষয়টি থাকতে হবে। এর পাশাপাশি লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে আইনের প্রয়োগ জরুরি। আইন আদৌ প্রয়োগ হচ্ছে কিনা তার উপর নজরদারি থাকাও প্রয়োজন।
স্বাস্থ্যের অধিকার একটা মৌলিক অধিকার। কিন্তু অর্ধেক জনসংখ্যার স্বাস্থ্যসূচক যদি নীচের দিকে থাকে তবে তা যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ। লিঙ্গ এবং এলাকা ধরে ভারতের জনস্বাস্থ্যের যাবতীয় তথ্যের বিশ্লেষণ প্রয়োজন। পাশাপাশি, প্রতিকূল প্রবণতার মোকাবিলায় বেশ কিছু নীতি এবং কর্মসূচি নেওয়া খুবই প্রয়োজন। বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে উঠে আসা তথ্য থেকে পরবর্তী লক্ষ্য স্থির করতে হবে। উন্নতি যেন দৃশ্যতই হয় এবং মানদণ্ড অনেক উঁচুতে ধরা থাকে।
স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বৈষম্যের পরিমাণটা অনেক সময়ে চিকিৎসক মহলেও ছোট করে দেখা হয়। ভারতীয় সমাজে নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে দেখা হয়। ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারী সংক্রান্ত বিষয়গুলি হয় উপেক্ষিত থেকে যায় আর না হয় পাত্তাই দেওয়া হয় না। এই প্রথাগত ছককে ভাঙতে সমগ্র গোষ্ঠী এবং জনসাধারণকে নিয়োজিত করার প্রয়োজন রয়েছে। লিঙ্গসমতা আনার কর্মসূচিগুলির লক্ষ্য শুধুমাত্র নারীদের সমান বা বেশি সুযোগ দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লিঙ্গ ফলাফলেও সমতা আনার লক্ষ্য থাকতে হবে। আর তখনই সাধারণ ভাবে ফলাফল এবং বিশেষ ভাবে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ফলাফল মাপা সম্ভব হবে।
লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে সমস্ত সামাজিক পরিকল্পনা এবং প্রকল্প লিঙ্গভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে হবে। নারীদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে হলে সব কর্মসূচিতে বাড়ি, স্কুল, কর্মক্ষেত্র, আইন এবং রাজনীতির মতো সামাজিক প্রেক্ষিতটি বিবেচনায় রাখতে হবে। ভারতে লিঙ্গবৈষম্য স্বাভাবিক করার ব্যাপারটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিতে হবে। বৈষম্যের প্রাথমিক প্রতিরোধের লক্ষ্য নিয়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতে পরিবর্তন আনতে হলে জনস্বাস্থ্যের ব্যাপারটিকেই কেন্দ্রবিন্দু করা উচিত। এর পাশাপাশি চলবে চিকিৎসা ব্যবস্থার মাধ্যমে হস্তক্ষেপ। অদূর ভবিষ্যতে ভারতের নারীরা যাতে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সমানাধিকার পায় এবং সমান সামাজিক মর্যাদা পায় তার জন্য প্রয়োজন প্রকৃত লিঙ্গভিত্তিক ন্যায়বিচার। (তথ্য সংগৃহীত)
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: