odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট ২০২৫, ৪ ভাদ্র ১৪৩২
উপ-সম্পাদকীয়

শান্তির দূত ট্রাম্প- ‘পিস টু প্রসপারিটি’র স্বপ্ন ও কূটনীতির নতুন খেলা

odhikarpatra | প্রকাশিত: ১৯ আগস্ট ২০২৫ ১৩:৩৬

odhikarpatra
প্রকাশিত: ১৯ আগস্ট ২০২৫ ১৩:৩৬

শান্তির নামে নতুন কূটনৈতিক খেলা উপভোগ করছে বিশ্ব। আবার অনেকে আশায় বুক বাধছে। এবার হয়তো যুদ্ধ বন্ধ হয়ে শান্তি প্রতিষ্টা সম্ভব হবে। আসলে বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে Donald John Trump (ডোনাল্ড ট্রাম্প) সর্বদাই বিতর্কিত চরিত্র। কখনো তাঁহাকে “জনতাবাদী নেতা” আখ্যায়িত করা হয়, কখনো আবার “অপ্রত্যাশিত কূটনীতিক” বলিয়া অভিহিত করা হয়। তবুও তিনি প্রায়শই নিজেকে শান্তির দূত” রূপে প্রতিষ্ঠিত করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। ভারত-পাকিস্তানের সংঘাত হইতে শুরু করিয়া ইসরায়েল-ফিলিস্তিন প্রশ্ন, আর সর্বশেষ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ—সবখানেই তিনি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় আবির্ভূত হইতে চাহিয়াছেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠিতেছে—ট্রাম্পের এই পদক্ষেপগুলি কি প্রকৃত শান্তির স্বপ্ন, নাকি বিশ্ব রাজনীতির দাবার কূটনৈতিক চাল?

বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ট্রাম্প: নতুন ম্যান্ডেটে প্রত্যাশা ও প্রশ্ন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৪৮ বছরের ইতিহাসে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে এক মেয়াদের বিরতির পর আবারও হোয়াইট হাউসে ফিরলেন রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী ডোনাল্ড জে. ট্রাম্প। সর্বশেষ নির্বাচনে তিনি পেয়েছেন ২৯৪টি ইলেক্টোরাল ভোট এবং ৭ কোটি ২৬ লাখেরও বেশি সাধারণ ভোট, আর তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট প্রার্থী ও বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস পেয়েছেন ২২৩টি ইলেক্টোরাল ভোট এবং ৬ কোটি ৭৯ লাখের বেশি ভোট। ফলাফলে রিপাবলিকানদের জন্য এটি যেমন একটি বড় জয়, তেমনি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে শান্তি ও কূটনীতির নতুন এক অধ্যায়ের ইঙ্গিত।

বৈশ্বিক প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জ

  • ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ: যুদ্ধবিরতি নয়, বরং স্থায়ী শান্তিচুক্তির দাবি তোলা হচ্ছে।
  • মধ্যপ্রাচ্য: ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতে ন্যায়ভিত্তিক সমাধান এখনো অধরা।
  • এশিয়া: চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলছে।
  • আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: জাতিসংঘসহ বহুপাক্ষিক মঞ্চগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা শান্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ট্রাম্পের ‘পিস টু প্রসপারিটি’ পরিকল্পনা

২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে পাশে লইয়া ট্রাম্প ঘোষণা করেন “Peace to Prosperity: A Vision to Improve the Lives of the Palestinian and Israeli People”। ঘোষণার মুহূর্তেই পরিকল্পনাটি বিশ্বে পরিচিত হয় “ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা” নামে।

কিন্তু প্রক্রিয়াটি জন্মলগ্নেই ছিল অসম্পূর্ণ। কারণ—ফিলিস্তিনি কোনো প্রতিনিধিকে আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় নাই। পরিকল্পনাটির কাঠামোয় ইসরায়েলের নিরাপত্তা স্বার্থকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়; ফিলিস্তিনের জন্য কেবল সীমিত সার্বভৌমত্ব ও কিছু অর্থনৈতিক সুবিধার প্রতিশ্রুতি রাখা হয়। সমালোচকেরা একে আখ্যা দিয়াছেন—ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি” নয়, বরং “ডিল অব ডিসপ্যারিটি”। অর্থাৎ শান্তির নামে এটি ছিল ইসরায়েলি আধিপত্যকে বৈধতা দানের প্রচেষ্টা।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে নতুন প্রস্তাব

দ্বিতীয় দফা হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তনের আলোচনায় ট্রাম্প পুনরায় বিশ্বকে চমকে দিলেন। আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি ঘোষণা করেন—সাময়িক যুদ্ধবিরতি নয়, দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য সরাসরি চুক্তিই একমাত্র পথ।”

তিনি দাবি করেন, ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ও ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও তিনি আলোচনায় রয়াছেন। ওয়াশিংটন পোস্ট একে বলেছে—নাটকীয় অবস্থান পরিবর্তন”। কিন্তু সমালোচকেরা বলিতেছেন—এটি মূলত রাশিয়ার স্বার্থসিদ্ধির পথ প্রশস্ত করিবার এক কৌশল।

ইউরোপীয় প্রতিক্রিয়া

ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, ব্রিটেন, ফিনল্যান্ড, পোল্যান্ডসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের যৌথ বিবৃতিতে ট্রাম্পের প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানানো হইলেও দ্বিধার ছাপ স্পষ্ট। তাহারা বলিয়াছেন—ইউক্রেনের ভূখণ্ড সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নেবে ইউক্রেনই।” অর্থাৎ ইউরোপীয় সমর্থন শর্তসাপেক্ষ; তাহারা সরাসরি রাশিয়াপন্থী কোনো সমাধান গ্রহণে প্রস্তুত নহে।

শান্তি নাকি কূটনৈতিক চালবাজি?

ট্রাম্পের পূর্ব অভিজ্ঞতা বিশ্বকে শিক্ষা দেয়—তাঁহার শান্তি প্রস্তাব প্রায়শই একপেশে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন পরিকল্পনায় যেমন ঘটিয়াছিল, এবারও ইউক্রেন প্রস্তাব সমালোচনার সম্মুখীন। সমালোচকেরা মনে করেন—তিনি বিশ্বশক্তির নিকট একটি বিকল্প কূটনৈতিক চরিত্র” নির্মাণে সচেষ্ট। সমর্থকেরা বলেন—সাময়িক যুদ্ধবিরতি নয়, বরং রাজনৈতিক চুক্তিই শান্তির পথ।

সুতরাং প্রশ্ন রহিল—এই উদ্যোগ কি সত্যই শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা, নাকি কেবল রাজনৈতিক কৌশলের নতুন অভিনয়?

পরিশেষে ইহাই বলিতে মর চায়, ট্রাম্পের পিস টু প্রসপারিটি” উদ্যোগ ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটে কার্যত ব্যর্থ হয়। ইউক্রেন-রাশিয়া প্রসঙ্গে তাঁহার নতুন প্রস্তাবও নানাবিধ বিতর্কে আবদ্ধ। শান্তি কখনো একপেশে বা চাপিয়ে দেওয়া যায় না। তাহা হইতে হইবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়সংগত ও আস্থাভিত্তিক।

ট্রাম্প হয়তো ইতিহাসে নিজেকে শান্তির দূত” রূপে অমর করিতে ইচ্ছুক। কিন্তু ইতিহাসই বলিবে—তিনি সত্যই শান্তির প্রতিনিধি হইতে পেরেছিলেন, নাকি থেকে গিয়াছেন কেবল রাজনৈতিক বিতর্কের চরিত্র।

-লেখক: ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমা লিটু, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকারপত্র, যোগাযোগ odhikarpatranews@gmail.com



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: