
বিশেষ প্রতিবেদন
লাদেশে দুর্গাপূজা এখন আর কেবল বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব নয়; এটি পরিণত হয়েছে সর্বজনীন এক সামাজিক-সাংস্কৃতিক আয়োজনে। পাহাড় থেকে সমতল, গ্রাম থেকে শহর—শারদীয় উৎসবের আনন্দে সামিল হচ্ছেন সব সম্প্রদায়ের মানুষ। এই উৎসবে নতুন মাত্রা যোগ করেছে দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর অংশগ্রহণ।
চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চল থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গের সাঁওতাল পল্লি, ময়মনসিংহের গারো পাহাড় কিংবা উপকূলীয় ওরাঁও জনগোষ্ঠী—সবাই নিজস্ব সাংস্কৃতিক রীতিনীতিতে দুর্গাপূজাকে আপন করে নিয়েছে। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্যমতে, অন্তত ১৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ এখন দুর্গাপূজা পালন করে থাকেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একসময় এসব জনগোষ্ঠী মূলত প্রকৃতিপূজারী হলেও বর্তমানে অনেকে সনাতন ধর্ম অনুসরণ করছেন। তবে তাঁরা নিজেদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখেই পূজা পালন করেন। মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির তথ্যমতে, ধর্মান্তরিত নন এমন প্রায় সব আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ আজ দুর্গাপূজায় যুক্ত রয়েছেন।
গত তিন দশকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পূজা আয়োজনেও এসেছে আড়ম্বর ও নান্দনিকতা। পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের পূজামণ্ডপগুলোতে দেখা যায় পাহাড়ি মোটিফে সাজসজ্জা, যেখানে বাঙালি ও পাহাড়িরা একত্রে পূজায় অংশ নেয়। বাঁশ-কাঠের মণ্ডপ, রঙিন জামদানি আর পাহাড়ি বস্ত্রের সমন্বয়ে তৈরি দেবীর আসন, আর সন্ধ্যায় ঢাকের সাথে মাদল ও পাহাড়ি বাদ্যযন্ত্রের সমবেত সুর—সব মিলিয়ে তৈরি হয় এক ভিন্নতর আবহ।
মারমা কিশোরীরা ঐতিহ্যবাহী নৃত্যে প্রাণবন্ত করে তোলে সন্ধ্যার পরিবেশ। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের পূজামণ্ডপেও দেখা মেলে একই চিত্র। দিনাজপুরের বিরামপুরে সাঁওতালদের পূজা মণ্ডপে দেখা যায়—মাদলের তালে তালে তরুণরা শোভাযাত্রায় অংশ নিচ্ছে। প্রবীণ সাঁওতাল পুরোহিত লালমোহন হাঁসদা বলেন, “দেবী দুর্গা শুধু অশুভ শক্তির বিনাশই করেন না, তিনি আমাদের নতুন ফসলের আশীর্বাদও নিয়ে আসেন। আমাদের কাছে পূজা মানে ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও কৃষি উৎসব—দুইয়ের সম্মিলন।”
এ কারণে এসব অঞ্চলে পূজায় দেবীর সঙ্গে উপস্থাপিত হয় নতুন ধান, শস্য ও ফলমূল। ফলে পূজায় ধর্মীয় ভক্তির সঙ্গে যুক্ত হয় কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতির ঐতিহ্যও।
অন্যদিকে, ময়মনসিংহের গারো পাহাড় অঞ্চলে গারো জনগোষ্ঠী ধর্মীয়ভাবে ভিন্ন হলেও পূজার সামাজিক পর্বে অংশ নেয় নাচ-গান ও পারফর্ম্যান্সের মাধ্যমে। খুলনা ও বরিশালের উপকূলীয় ওরাঁও ও বেদে সম্প্রদায়ের মানুষেরাও দুর্গাপূজায় অংশ নেন যাত্রাপালা, নাটক ও লোকসংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে।
নৃবিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলার দুর্গোৎসব কেবল ধর্মীয় আয়োজন নয়—এটি হয়ে উঠেছে সামাজিক ঐক্যের প্রতীক। গ্রামীণ সমাজে দুর্গাপূজা সবসময়ই মানুষের মধ্যে সম্পর্ককে দৃঢ় করেছে। আজ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণ সেই সামাজিক বন্ধনকে আরও বিস্তৃত করছে।
বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেখা যাচ্ছে আগ্রহের নতুন ধারা। পূজা মানেই শুধু ধর্মীয় রীতিনীতির অনুসরণ নয়, বরং এটা এক সাংস্কৃতিক মিলনক্ষেত্র—যেখানে ঢাক, উলুধ্বনি, শোভাযাত্রা আর বিজয়া দশমীর আনন্দে মিলেমিশে যায় ধর্ম, জাতি ও ভাষার ভিন্নতা।
পূজা মণ্ডপগুলোতে দেখা যায়, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান বন্ধুরাও আসছেন আনন্দ ভাগ করে নিতে। এই বহুত্ববাদী অংশগ্রহণই প্রমাণ করে—বাংলাদেশে দুর্গাপূজা কেবল এক ধর্মের উৎসব নয়, বরং এটি আজ একটি জাতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বহ্নিশিখা।
- বিশেষ প্রতিনিধি (Special National Correspondent) মোঃ সাইদুর রহমান (বাবু)
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: