odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Saturday, 15th November 2025, ১৫th November ২০২৫
ধর্মীয় ভণ্ডামি আর সামাজিক জাগরণের সন্ধিক্ষণে আমরা-সম্পাদকীয়

ধর্মের কল বাতাসে নড়ে: মুখোশ খসে পড়ছে, ন্যায়ের বাতাস বইছে

odhikarpatra | প্রকাশিত: ৩০ September ২০২৫ ২১:০০

odhikarpatra
প্রকাশিত: ৩০ September ২০২৫ ২১:০০

সম্পাদকীয়

বাংলা ভাষার এক চিরন্তন প্রবাদ—“ধর্মের কল বাতাসে নড়ে”। এ প্রবাদ শুধুমাত্র লোকজ প্রজ্ঞার ফল নয়, এটি একটি সভ্যতার মূল্যবোধ, একটি মৌলিক সত্যের আভাস—যে সত্য চাপা থাকে না, যে অনাচার ঢেকে রাখা যায় না, যে মুখোশ চিরকাল পরিহিত থাকতে পারে না। সময় আসে, যখন বাতাসই প্রকাশ করে দেয় সুপ্ত কলের শব্দ। আজ, আমাদের সমাজ যেন সেই বাতাসেই সাড়া দিচ্ছে—ধর্মের নামে লিপ্ত ভণ্ডামি ও অবিচারের বিরুদ্ধে।

ধর্ম, মানবজাতির ইতিহাসে এক পরম পাথেয়। এ পাথেয় আমাদের দিয়েছে নৈতিকতার ভিত্তি, করুণা, সহমর্মিতা এবং আত্মশুদ্ধির পথ। কিন্তু কালের ধারায়, কিছু চতুর হাত এ ধর্মকেই বানিয়েছে বাণিজ্য, রাজনীতি ও দম্ভের মোড়ক। ধর্ম নয়, ধর্মের মোড়কে বিকোতে বসেছে ক্ষমতা, প্রভাব ও বিভাজন। একে আমরা বলি ধর্মব্যবসা—যা ধর্মের আড়ালে অসত্যের জলরেখা টেনে দেয়।

অথচ, আজকের সমাজ আর নিঃশব্দে থাকছে না। প্রযুক্তি আর জনমত এখন এক অদৃশ্য বাতাস—যা নিঃশব্দে ঘুরে বেড়ায়, গৃহের চার দেয়াল ভেদ করে পৌঁছে যায় মুখোশের আড়ালে। মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ধরা পড়ে সোনার চামচে ভাত খাওয়া ধর্মীয় নেতার ছবি, ওয়াজের মঞ্চে সদা সজ্জিত ভক্তের দৃষ্টিতে পড়ে যায় বক্তার দামি ঘড়ির ঝিলিক। মানুষ প্রশ্ন তোলে—“ঈশ্বর কি এসব চান?”

না, ঈশ্বর বা আল্লাহ্‌ বা ভগবান কখনোই চাননি—তাঁর নামে বিভাজন, লোভ, বা অন্যের উপর দমন। কিন্তু যুগে যুগে কিছু মুখোশধারী এই ধর্মীয় আচ্ছাদনে নিজেদের স্বার্থে নির্মাণ করেছে এক অশুভ সাম্রাজ্য।

আজ, সেই সাম্রাজ্যের দেয়ালে দেখা যাচ্ছে ফাটল। কারণ—মানুষ জেগেছে। তারা চোখ মেলে দেখছে, কান পেতে শুনছে, এবং সাহস করে বলছে। সামাজিক মাধ্যম শুধু বিনোদনের পুঁজি নয়, এটি হয়ে উঠেছে ন্যায়ের বাতিঘর। সেখানেই প্রমাণ হয়, “ধর্মের কল বাতাসে নড়ে”—এ কথা নিছক ছড়ার ছন্দ নয়, এটি আচরণের প্রতিচ্ছবি।

আজকের এই সমাজে যারা সত্য ও ধর্মের সত্যিকার মূল্যের পক্ষে দাঁড়ায়, তাদের পায়ের নিচেই জমি শক্ত। যারা ধর্মকে অপব্যবহার করে, তাদের মঞ্চ আজ কাঁপছে। জনগণ এখন আর চুপ নয়—তারা প্রশ্ন করে, যুক্তি দেয়, বিশ্লেষণ করে। এটাই তো আত্মজাগরণ। এটাই তো ন্যায়ের দিকে হাঁটা।

আমরা চাই, ধর্ম হোক এক নৈতিক অভিযাত্রা—যেখানে থাকবে না বিভাজনের দেয়াল, থাকবে না ভয়ভীতির শিকল। ধর্ম হোক এমন একটি সার্বজনীন মেলবন্ধন, যেখানে মানুষ মানুষকে আপন করে নেয়, বিচার করে কর্ম ও চরিত্রের ভিত্তিতে—বর্ণ বা বিশ্বাসের নয়।

এই যুগে বাতাস বড় সতর্ক। সত্যকে আর চেপে রাখা যায় না। ধর্মের কল আজও নড়ে—শুধু সময় লাগে তার সাড়া পৌঁছাতে। কিন্তু সে সাড়া একবার যখন আসে, তখন আকাশে জমে ওঠা সব ভণ্ড মুখোশ খসে পড়ে, প্রতিধ্বনির মতো জেগে ওঠে মানুষের বিবেক।

আমরা সেই জাগরণের দিকে তাকিয়ে আছি—যেখানে ধর্ম হবে হৃদয়ের আলো, শাসনের চাবুক নয়।

লেখকঅধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপদেষ্টা সম্পাদক, odhikarpatranews@gmail.com  



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: