মানব জীবনের দুঃখ, সুখ, ত্যাগ ও মানবিক ব্রতের গভীর দর্শন নিয়ে লেখা এই সাহিত্যধর্মী সাংবাদিক ফিচারটি তুলে ধরে মানুষের অন্তর্গত লড়াই, পরহিতব্রত, স্বার্থত্যাগ ও সত্যিকারের সুখের উৎস। জীবনের বিষাদকে শক্তিতে রূপান্তরের পথ এবং মানব জনমের অর্থ খুঁজতে পাঠককে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়।
মানব জনম: এক জীবন–দর্শকের অনুসন্ধান
জীবনের পথে হেঁটে যেতে যেতে আমরা সবাই কখনো না কখনো থেমে যাই এক পুরোনো প্রশ্নের সামনে। “নাই কিরে সুখ? নাই কিরে সুখ? এই ধরা কি শুধু বিষাদে বাঁধা?” এই প্রশ্ন একার নয়। এটি যুগে যুগে মানুষের বুকের ভেতর জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস, যা যেন এক অদৃশ্য বীণের তারে টান দেয়। জীবনের পথে যত দূর এগনো যায়, এই একটা প্রশ্ন আমাদের কখনো না কখনো থামিয়ে দিবেই: এই পৃথিবী কি শুধু দুঃখের? সুখ কোথায়? কেন আমরা বারবার হেরে যাই নিজেরই হতাশার কাছে? আসলে এই প্রশ্ন কোনো মানবের একার নয়। এটি যুগে যুগে মানুষের বুকের ভেতর জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস, যা যেন এক অদৃশ্য বীণের তারে টান দেয়।
জীবনের পথে হেঁটে যেতে যেতে আমরা সবাই কখনো না কখনো থেমে যাই এক পুরোনো প্রশ্নের সামনে যেন বড়ই অসহায় হতে হয। আর জীবনের দু:সময়ে তা হারে হারে উপলব্দি করা যায়। । জীবনের এই বিষাদের অভিজ্ঞতা এক নতুন আত্মপোলব্দির জন্ম দেয। তখন মনে মনে চিন্তায় চলে আসে, তাহলে কি আমরা সত্যিই শুধুই কাঁদতে, হারাতে, আর মায়ার জালে জড়িয়ে পড়তেই এই পৃথিবীতে এসেছি? বিশ্বরচয়িতা কি মানব জাতিকে কেবল বিপন্নতার ঘূর্ণিতে ফেলে রেখে গেছেন?
জীবনের এই ধরণের প্রশ্ন ও বিষাদের অভিজ্ঞতা নতুন নয়। এটি মানুষের সম্মিলিত অভিজ্ঞতা। সময়ের পর সময় আমাদের অন্তর্গত বীণায় একই সুরে বাজতে থাকা অনিশ্চয়তা। তবু এমন মুহূর্তে মনে পড়ে যায় এক প্রত্যাখ্যান–বাক্য, যা বারবার ফিরিয়ে দেয় আমাদের সেই নীরস অন্ধকার থেকে:“মানুষ শুধু কান্নার জন্য জন্মায় না; তার সামনে আছে উচ্চ লক্ষ্য, উচ্চ আনন্দ।”
মানব জীবনের অন্ধকার কালো দিকে উদিত সন্দেহের বাতিক যখন মন ঢেকে ফেলে, তখনই কবির কণ্ঠ বজ্রধ্বনির মতো জেগে ওঠে: “না,—মানবের তরে আছে উচ্চ লক্ষ্য। সুখ উচ্চতর। কাঁদাতে নরে সৃজেননি বিধি।” এই পথের অন্বেষণই শুরু হয় মানুষের আসল যাত্রা।
১. সংসার: এক নীরব সমরক্ষেত্র, যেখানে কঠিনতম যুদ্ধটা নিজের সঙ্গেই
আমরা সাধারণত যুদ্ধ বলতে বাহ্যিক লড়াই বুঝি। কিন্তু জীবনের আসল সমরক্ষেত্রটি আমাদের ভেতরেই। এখানে শত্রু কোনো মানুষ নয়; শত্রু নিজের দুর্বলতা, ক্ষোভ, আত্মকেন্দ্রিকতা। যে মানুষ সকালে উঠে শুধু নিজের অসহায়তা গুনতে থাকে, কিংবা দিনের পর দিন চারপাশকে দোষারোপ করে কাটায়, সে কখনোই এই যুদ্ধের বীর সাজতে পারে না। জীবনের সুখ আসে ভেতরের এই যুদ্ধে জিততে পারলে। আর এই জয় ক্ষমতা বা সম্পদের নয়—নিজেকে অতিক্রম করার।
জীবনের রণভূমিতে বীরবেশ নেওয়ার কথা কবিরা বহুবার বলেছেন। কিন্তু এই যুদ্ধ কোনো বাহ্যিক শত্রুর বিরুদ্ধে নয়।এ যুদ্ধ নিজের ভেতরের ক্ষুদ্রতা, স্বার্থপরতা, ভীতি আর হীনমন্যতার বিরুদ্ধে। যে মানুষ চারপাশে ঘোরে রামগরুড়ের ছানার মতো মুখ ভার করে, কিংবা কানার হাট বাজারের মতো অস্থির ভঙ্গিতে, সে কখনোই এই বীরের আকৃতি ধারণ করতে পারে না। অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ জিততে পারলেই সত্যিকারের সুখ আমাদের দিকে হাত বাড়ায়। কিন্তু এ সুখ ক্ষমতা, টাকাপয়সা বা বাহাদুরির নয়। উদ্দেশ্যের, দায়িত্বের এবং হৃদয়ের।
২. পরের কারণে স্বার্থত্যাগ: সুখের প্রকৃত সূত্র এবং গোপন দরজা
একটি কথা আমরা যতই শুনি, সত্যতা ততই গভীর হয়: নিজের জন্য সুখ খুঁজলে তা অধরাই থাকে। পরের জন্য করলে তা নিজের দরজায় ফিরে আসে। মানুষের সমস্ত উন্নয়নের মূল বীজটাই এই জায়গায়। তাইতো কবি দেখান মানব জীবনের মৌল সত্যটি: “পরের কারণে স্বার্থে দিয়া বলি এ জীবন মন সকলি দাও।” আর কবির এই বাণীর সাথে যত বৈপরীত্যই ব্যক্তির কাছে মনে হোক না কেন, সত্যিকারের সুখ নিজের জন্য নয়। সুখ তখনই জন্ম নেয়, যখন আমরা নিজের স্বার্থ একটু সরিয়ে রাখি।
কারও বোঝা কাঁধে তুলে নেওয়া, কারও হাসি নিশ্চিত করতে নিজের আরামের ভাগ ছেড়ে দেওয়া—এই ত্যাগের গভীরে যে শান্তি রয়েছে, তা কোনো সম্পদ দিয়ে কেনা যায় না। কারও হাসি ফোটাতে নিজের স্বার্থ সামান্য সরিয়ে রাখা—এটাই সেই ত্যাগ, যা কখনো ক্ষতি দেয় না। বরং হৃদয়ের ভেতর এক অজানা শান্তি ঢেলে দেয়। কবির ভাষায়, ‘পরের কারণে মরণও সুখ’। এই মরণ কোনো দেহের নয়; মরণ স্বার্থের, অহংকারের। আর এই ত্যাগই মানুষকে মুক্তি দেয় ভয়, হতাশা ও অসহায়তা থেকে।
পরহিতের জন্য ‘মরণের সুখ’—শুধু কবিতার পঙক্তি নয়; এটি হৃদয়ের মুক্তি। যে নিজের জীবনকে অন্যের কল্যাণে বিলিয়ে দিতে পারে, সে মৃত্যুকেও ভয় পায় না।
৩. বিষাদকে শক্তিতে রূপান্তর: স্নিগ্ধ তারার শিক্ষা
দুঃখ আসবে। স্বপ্ন ভাঙবে। জীবন থেমে যাবে বারবার। কিন্তু দুঃখকে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কবি বলেন, বিষাদকে রাখতে হবে “মৃদুভাতি স্নিগ্ধ তারার মত”। যেমন তারা অন্ধকারের বুক চিরে নীরবে আলো ছড়িয়ে যায়, তেমনি আমাদের হৃদয়ের ব্যথাও নীরব শক্তিতে পরিণত হোক। এই নীরবতা দুর্বলতা নয়—এ হলো ধৈর্যের দীপ্তি। এ হলো সেই মহৎ শক্তি, যা নিজের ভার নিজের ভেতর গোপন রেখে অন্যের মুখে হাসি ফোটায়।
জীবনে দুঃখ আসবে। অপ্রত্যাশিত ভাঙনও আসবে। কিন্তু সেই দুঃখকে সারাক্ষণ ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রকাশ করে কী লাভ? কবি বলেন, বিষাদকে রাখতে হবে রাতের স্নিগ্ধ তারার মতো—নীরব, সংযত, শান্ত। যেমন তারা অন্ধকারের ভিতর থেকে আলো ছড়ায়, তেমনি মানুষও নিজের ভেতরের দুঃখকে শক্তিতে বদলে নিতে পারে। নিজের কষ্ট আড়ালে রেখে যদি আমরা অন্যের মুখে একটু হাসি ফোটাতে পারি—সেইটিই মানবতার সবচেয়ে বড় পরিচয়। তাইদতা নিম্নের প্রশ্নেই যে লুকিয়ে আছে মানবতার প্রকৃত চ্যালেঞ্জ।
“সকলের মুখ হাসি-ভরা দেখে, পার না মুছিতে নয়ন-ধার?”
শেষ কথা: আমরা কার জন্য বাঁচি?
জীবনের বড় সংকটগুলো আসলে এক জায়গায় গিয়ে মেলে—নিজেকে নিয়ে অতিরিক্ত ব্যস্ততা। জীবনের এই সব বিষাদ, অস্থিরতা, বিভ্রান্তি—সব কিছুর শিকড় কিন্তু এক – আর তা হচ্ছে আমিত্বের মোহে নিজেকে নিয়ে অতিব্যস্ততা। মানুষ যখন শুধু নিজের দুঃখ, নিজের ভয়, নিজের ক্ষতি নিয়ে ভাবতে থাকে, তখন জীবন ছোট হয়ে আসে। কবি তাই শেষ কথাটি মনে করিয়ে দেন:
“আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী ‘পরে।
সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।”
মানব জীবনের আসল মহিমা এখানেই—সত্যিকারের মহিমা হচ্ছে নিজেকে ছাড়িয়ে অন্যের দিকে হাত বাড়ানো। সর্বস্ব দিয়ে অন্যের জন্য বাঁচার মধ্যে যে আনন্দ, যে স্বস্তি, যে অর্থ, তা কোনো বিষাদের ছলনায় ঢাকা পড়ে না। এই পৃথিবীকে একটু কম বিষাদময় এবং একটু বেশি মানবিক করার পথ এইটিই। সুখ দূরে নয়; সুখ লুকিয়ে আছে পরের জন্য বাঁচার মধ্যেই। হৃদয়কে একটু বড় করতে পারলেই তা ধরা দেয়। মনে রাকতে হবে জীবনের উচ্চ ব্রত হলো—নিজেকে ভুলে অন্যের জন্য পথ তৈরি করা। সেই পথেই পাওয়া যায় শান্তি, পাওয়া যায় আলো, পাওয়া যায় মানব জন্মের সত্যিকারের মানে।
✍️ –অধ্যাপক ড. মাহবুব লিটু, উপদেষ্টা্ সম্পাদক, অধিকারপত্র (odhikarpatranews@gmail.com)

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: