
এক বছর আগে ২০২৪ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কায় পানামার একটি দ্বীপ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল প্রায় ১,২০০ বাসিন্দাকে। সেই দ্বীপ আজ নীরব, জনমানবশূন্য, শিশুর কোলাহলহীন। গারদি সুগদুব দ্বীপের এই পরিকল্পিত স্থানান্তর ছিল লাতিন আমেরিকায় জলবায়ু উদ্বাস্তু তৈরির অন্যতম প্রথম উদাহরণ।
ছোট্ট একটি জাদুঘরের দেখভাল করেন স্থানীয় অধিবাসী ডেলফিনো ডেভিস। সেখানে রাখা আছে পুরোনো বর্শা, মাটির কলস আর নানা প্রাণীর হাড়গোড়। তিনি এএফপিকে বললেন, ‘এখানে এখন আর কোনো বন্ধু নেই, নেই কোনো শিশুর খেলাধুলা—এই দ্বীপটা যেন মৃত।’
প্রায় পাঁচটি ফুটবল মাঠের সমান আয়তনের দ্বীপটিতে এখন তালাবদ্ধ ঘর আর পরিত্যক্ত ক্লাসরুম। ছোট একটি দোকান চালান মাইকা তেজাদা (৪৭)। সেখানে কলা, কুমড়া, জামা-কাপড়, খেলনা আর খাতা-কলম বিক্রি করেন তিনি। বললেন, ‘এখানে আর কেউ থাকে না। অনেক সময় একা একা থাকতে থাকতে মন খারাপ হয়ে যায়।’
তেজাদাসহ শতাধিক মানুষ দ্বীপেই থেকে গেছেন, কিন্তু তার মা ও দুই সন্তান চলে গেছেন মূল ভূখণ্ডে গড়ে ওঠা নতুন আবাসনে—ইসবার ইয়ালা, যার অর্থ গুনা ভাষায় ‘লকাটের দেশ’। দ্বীপ থেকে নৌকায় মাত্র ১৫ মিনিট দূরে অবস্থিত এই নতুন পাড়াটিতে পানামা সরকার ৩০০টি ঘর নির্মাণ করে দিয়েছে।
গারদি সুগদুব গুনা ইয়ালা দ্বীপপুঞ্জের ৪৯টি বসতিপূর্ণ দ্বীপের একটি। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, এই দ্বীপপুঞ্জ শতকের শেষ নাগাদ সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যেতে পারে।
‘আমি এখানেই মরব’
লুসিয়ানা পেরেসের বয়স ৬২ বছর। ওষধি গাছের গন্ধে ভরা কাঁচা মেঝের বাড়িতে দোলনায় বসে বললেন, ‘আমি গারদি দ্বীপেই জন্মেছি, এখানেই মরব। কিছুই তলিয়ে যাচ্ছে না। বিজ্ঞানীরা কিছু জানে না— কেবল খোদাই সব জানেন।’
তিনি বলেন, শৈশব থেকেই তিনি বড় বড় ঢেউ আর জোয়ারে ঘর-বাড়ি প্লাবিত হতে দেখে আসছেন।
পানামার স্মিথসোনিয়ান ট্রপিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী স্টিভেন পেটন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৮০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। অথচ গুনা ইয়ালা দ্বীপগুলোর উচ্চতা গড়ে মাত্র ৫০ সেন্টিমিটার।
জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন কপ৩০-এর প্রধান নির্বাহী আনা টনি বলেন, ‘এই সমষ্টিগত স্থানান্তর প্রমাণ করে, জলবায়ু সংকট বাস্তব, এবং আমরা এখনই তার মুখোমুখি।’
পাকা রাস্তা, টয়লেট আর বিদ্যুৎ
গারদি সুগদুবে এখন বর্ষা আসায় কাদায় ভরে গেছে কাঁচা রাস্তাগুলো। অন্যদিকে, মূল ভূখণ্ডে গড়ে ওঠা ইসবার ইয়ালায় পাকা রাস্তা, পাকা ঘর, ফুটপাত আর একটি করে জমির টুকরো রয়েছে—সবই ৫০ বর্গমিটার আয়তনের কংক্রিটের বাড়ির সঙ্গে।
‘আগে সবাই মিলে গাদাগাদি করে থাকতে হতো। নদী থেকে নৌকায় করে পানি আনতাম’, বলেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা মাগদালেনা মার্টিনেজ (৭৫)। এখন সকালে এক ঘণ্টা পানির সংযোগ পান তিনি, আর বিদ্যুৎ থাকে ২৪ ঘণ্টাই।
তেজাদার দুই সন্তানও দ্বীপ ছেড়ে যাওয়ায় খুশি। ‘আমি ওদের মিস করি। কিন্তু ওরা ওখানে খুশি। ফুটবল খেলার জায়গা পেয়েছে, হাঁটাহাঁটি করতে পারে।’
দ্বীপের স্কুলটি সরিয়ে নেওয়া হলেও ছোট্ট একটি জরাজীর্ণ চিকিৎসাকেন্দ্র এখনও সেখানে রয়েছে। চিকিৎসক জন স্মিথ (৪৬) বললেন, ‘আগে মানুষ পায়ে হেঁটে আসত। এখন আসতে হয় সড়ক আর নদী পাড়ি দিয়ে।’
অনেকেই দ্বীপে আসে কেবল বাড়ির খোঁজখবর নিতে। কেউ কেউ দুজায়গায় ভাগ করে সময় কাটান। এ সপ্তাহে দ্বীপে কিছুটা সরবতা ফিরবে—ইসবার ইয়ালার প্রথম বর্ষপূর্তিতে সেখানকার উৎসবের জন্য সাত কলস চিচা (গাঁজন করা ভুট্টার পানীয়) প্রস্তুত করা হয়েছে।
তবে নতুন জীবন আর আধুনিক সুযোগসুবিধার মধ্যেও অনেকে আগাম আশঙ্কা করছেন, দ্বীপটির ভবিষ্যৎ হয়তো অনিবার্য। মার্টিনেজ বললেন, ‘হয়তো আমি দেখে যেতে পারব না, কিন্তু দ্বীপগুলো একদিন হারিয়ে যাবে। কারণ সমুদ্র নিজের জায়গা ফেরত নেবে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: