odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | বৃহঃস্পতিবার, ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১৩ ভাদ্র ১৪৩২
প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানদন্ডের আলোকে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং বনাম বিএসসি ইন ইঞ্জিনিয়ারিং: যোগ্যতার পার্থক্য ও প্রেক্ষাপট

odhikarpatra | প্রকাশিত: ২৮ আগস্ট ২০২৫ ০৪:২৯

odhikarpatra
প্রকাশিত: ২৮ আগস্ট ২০২৫ ০৪:২৯

বাংলাদেশে প্রকৌশল শিক্ষার অঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরে এক অদৃশ্য টানাপোড়েন বিরাজ করছে। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রিধারী B.Sc. Engineer, অন্যদিকে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে উত্তীর্ণ Diploma Engineer. উভয়েই নিজেদের অবস্থানকে বৈধ ও মর্যাদাপূর্ণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান। সাম্প্রতিক সময়ে শাহবাগ অবরোধ এই দ্বন্দ্বকে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে। এর পেছনে মূলত একাডেমিক পার্থক্য এবং কর্মক্ষেত্রে যোগ্যতার পার্থক্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

একাডেমিক কাঠামোর পার্থক্য

১. Diploma in Engineering (ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং):

  • চার বছর মেয়াদি কারিগরি শিক্ষা (পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ভিত্তিক)।
  • ভর্তির যোগ্যতা: এসএসসি (বিজ্ঞান বিভাগ বা সমমান)।
  • লক্ষ্য: মধ্যম পর্যায়ের টেকনিশিয়ান বা সুপারভাইজার তৈরি করা।
  • আন্তর্জাতিকভাবে এটি ISCED Level 4 (Post-secondary non-tertiary education) হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ, যা উচ্চমাধ্যমিকের পরবর্তী স্তর হলেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা নয়।
  • বাংলাদেশ ন্যাশনাল ট্রেনিং অ্যান্ড ভোকেশনাল কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্কে (NTVQF) এর অবস্থান Level 5: Highly Skilled Worker, অর্থাৎ নির্দিষ্ট টেকনিক্যাল কাজ দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করা ও ছোট টিম পরিচালনা।

২. B.Sc. in Engineering (বিএসসি ইন ইঞ্জিনিয়ারিং):

  • চার বছর মেয়াদি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা (বুয়েট ও অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়)।
  • ভর্তির যোগ্যতা: এইচএসসি (বিজ্ঞান বিভাগ), প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষা।
  • লক্ষ্য: পরিকল্পনাকারী, গবেষক, নকশাবিদ এবং উচ্চ পর্যায়ের পেশাদার প্রকৌশলী তৈরি করা।
  • আন্তর্জাতিকভাবে এটি ISCED Level 6 (Bachelor’s or equivalent level) হিসেবে স্বীকৃত, যা উচ্চশিক্ষার স্নাতক ডিগ্রি স্তর।
  • বাংলাদেশ ন্যাশনাল কোয়ালিফিকেশনস ফ্রেমওয়ার্কে (BNQF) এটি Level 6 ও Level 7: Supervisor/Middle Level Manager, যেখানে দল পরিচালনা, পরিবর্তন ব্যবস্থাপনা ও জটিল সমস্যার সমাধান করার দক্ষতা আবশ্যক।

জ্ঞান ও দক্ষতার পার্থক্য

  • Diploma Engineer → ব্যবহারিক/হাতেকলমে কাজ, মাঠপর্যায়ের বাস্তবায়ন, টেকনিক্যাল অপারেশন, যন্ত্রপাতি ও প্রজেক্টের তদারকি।
  • Sc. Engineer → তাত্ত্বিক জ্ঞান, গবেষণাভিত্তিক সমাধান, জটিল নকশা, উদ্ভাবন, পরিকল্পনা ও নীতিনির্ধারণ।

সহজভাবে বলা যায়, ডিপ্লোমা প্রকৌশলী হলেন দক্ষ কর্মী ও কারিগরি বাস্তবায়নকারী, আর স্নাতক প্রকৌশলী হলেন পরিকল্পনাকারী ও উদ্ভাবক।

কর্মক্ষেত্রে অবস্থান

  • ডিপ্লোমাধারীরা সাধারণত টেকনিশিয়ান, সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার, সুপারভাইজার পদে নিয়োগ পান।
  • স্নাতক প্রকৌশলীরা সহকারী প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী বা সমমানের পদে কাজ শুরু করেন।

ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং (ISCED Level 4) বনাম বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং (ISCED Level 6): আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে তুলনামূলক আলোচনা

ইউনেস্কো ইনস্টিটিউট ফর স্ট্যাটিসটিকস (UIS) প্রণীত International Standard Classification of Education (ISCED 2011) হলো একটি বৈশ্বিক কাঠামো, যার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের শিক্ষা কার্যক্রম ও যোগ্যতার মান নির্ধারণ ও তুলনা করা হয়। এই মানদণ্ড অনুযায়ী ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ও বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাক্রম দুটি ভিন্ন স্তরে (Level 4 ও Level 6) শ্রেণিভুক্ত। নিচে দুইটির প্রধান পার্থক্য তুলে ধরা হলো—

১. শিক্ষার স্তর ও শ্রেণিবিন্যাস

  • ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং (ISCED Level 4: Post-secondary Non-tertiary Education)
    • এটি মাধ্যমিকোত্তর কিন্তু উচ্চশিক্ষার অন্তর্ভুক্ত নয়—অর্থাৎ মাধ্যমিক স্তরের উপরে, তবে টারশিয়ারি স্তরের (Higher/Tertiary) নিচে।
    • সাধারণত ISCED Level 3 (উচ্চমাধ্যমিক) শেষ করা শিক্ষার্থীরা এতে ভর্তি হতে পারে।
    • বিষয়বস্তু মাধ্যমিকের চেয়ে বিশেষায়িত, কিন্তু জটিলতার দিক থেকে উচ্চশিক্ষার পর্যায়ে পৌঁছায় না।
  • বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং (ISCED Level 6: Bachelor’s or Equivalent Level)
    • এটি পূর্ণাঙ্গ টারশিয়ারি শিক্ষা বা উচ্চশিক্ষার প্রথম ডিগ্রি।
    • সাধারণত ৩–৪ বছরের পূর্ণকালীন অধ্যয়ন শেষে ডিগ্রি প্রদান করা হয়।
    • গবেষণা, উন্নত প্রযুক্তি ও পেশাগত অনুশীলনভিত্তিক শিক্ষা এই স্তরে অন্তর্ভুক্ত থাকে।

২. শিক্ষার উদ্দেশ্য ও বৈশিষ্ট্য

  • ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং
    • মূল উদ্দেশ্য হলো দ্রুত শ্রমবাজারে প্রবেশের উপযোগী কারিগরি দক্ষতা তৈরি।
    • বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টার্মিনাল প্রোগ্রাম; তবে কিছু প্রোগ্রাম টারশিয়ারি (Level 5/6) প্রবেশাধিকার দেয়।
    • বিশেষায়িত টেকনিশিয়ান, সুপারভাইজার বা টেকনিক্যাল সাপোর্ট কর্মী তৈরি হয়।
  • বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং
    • উদ্দেশ্য হলো গভীরতর তাত্ত্বিক ও পেশাগত জ্ঞান প্রদান করে প্রকৌশলী তৈরি করা।
    • শিক্ষার্থীদের গবেষণা, উদ্ভাবন ও উচ্চতর পড়াশোনার (Masters, PhD) পথ উন্মুক্ত করে।
    • গ্র্যাজুয়েটরা সাধারণত পেশাদার প্রকৌশলী হিসেবে স্বীকৃতি পান।

৩. শিক্ষাক্রমের জটিলতা ও বিষয়বস্তু

  • ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং
    • বিষয়বস্তু মাধ্যমিক স্তরের চেয়ে অল্প উচ্চতর, কিন্তু টারশিয়ারি পর্যায়ের মতো জটিল নয়।
    • শিক্ষাক্রমে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টেকনিক্যাল ও প্র্যাক্টিক্যাল দিক প্রাধান্য পায়।
  • বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং
    • পাঠ্যক্রম গবেষণা, গণিত, বিজ্ঞানের উন্নত জ্ঞান, ও পেশাগত অনুশীলনভিত্তিক।
    • আধুনিক প্রযুক্তি ও গবেষণার ফলাফল শিক্ষাদানের সাথে যুক্ত থাকে।
    • শিক্ষকের যোগ্যতা সাধারণত মাস্টার্স বা পিএইচডি স্তরের হয়ে থাকে।

৪. শিক্ষার মেয়াদ ও প্রবেশাধিকারের শর্ত

  • ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং
    • মেয়াদ সাধারণত ৩–৪ বছর (মাধ্যমিকের পরে)।
    • ISCED Level 3 সমাপ্তি আবশ্যক, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কড়া প্রবেশিকা থাকে না।
  • বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং
    • মেয়াদ সাধারণত ৪ বছর, কিছু দেশে দীর্ঘমেয়াদী (৫ বছর) প্রোগ্রামও আছে।
    • প্রবেশের জন্য মাধ্যমিক/ডিপ্লোমা স্তরে নির্দিষ্ট গ্রেড ও প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষা আবশ্যক।

৫. কর্মক্ষেত্র ও অগ্রগতির সুযোগ

  • ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং
    • সরাসরি শ্রমবাজারে প্রবেশ—মাঝারি পর্যায়ের টেকনিক্যাল ও সাপোর্ট রোলে।
    • উচ্চশিক্ষায় (BSc) প্রবেশাধিকার কিছু ক্ষেত্রে সীমিত বা শর্তসাপেক্ষ।
  • বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং
    • প্রকৌশলী হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি।
    • উচ্চশিক্ষা (Masters, PhD) এবং গবেষণাক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ।
    • প্রশাসনিক, গবেষণা ও পেশাদার প্রকৌশল চর্চায় পূর্ণ অধিকার।

সারসংক্ষেপ

ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং (ISCED Level 4) মূলত কারিগরি ও পেশাগত দক্ষতা অর্জনের মধ্যবর্তী ধাপ, যা শ্রমবাজারে দ্রুত প্রবেশ নিশ্চিত করে। অন্যদিকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং (ISCED Level 6) হলো পূর্ণাঙ্গ উচ্চশিক্ষা ও প্রকৌশলীর মর্যাদা অর্জনের ভিত্তি, যা উচ্চতর জ্ঞান, গবেষণা ও পেশাদার স্বীকৃতির পথ খুলে দেয়। বাংলাদেশের প্রকৌশল শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে Diploma Engineer ও B.Sc. Engineer–এর মধ্যে পার্থক্য বাস্তব, একাডেমিক এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। উভয় ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে—একজন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন, অন্যজন প্রকল্প পরিকল্পনা করেন। তাই দ্বন্দ্ব নয়, বরং সুস্পষ্ট দায়িত্ব বিভাজন ও যোগ্যতার স্বীকৃতির মাধ্যমে প্রকৌশল খাতকে এগিয়ে নেওয়াই সময়ের দাবি।

বি.দ্র.

বুয়েটসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল শিক্ষার্থীরা রাজপথে কেন তা জানতে পড়ুন বিশেষ সম্পাদকীয় নোট (Editorial Note) কনফ্লিক্ট অব ডিসসিপ্লিন: একাডেমিক মর্যাদা বনাম প্রফেশনাল স্বার্থ (https://odhikarpatra.com/news/31634)

এবং

সমাধান জানতে পড়ুনপ্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই আন্দোলনেরসমাপ্তি কোথায়? দুই সংগটনের ইগোতেপাল্টাপাল্টি আন্দোলনে জর্জরিত শিক্ষাঙ্গন (https://odhikarpatra.com/news/31635 )

— লেখক: ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান (লিটু), অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকা্রপত্র, odhikarpatranews@gmail.com



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: