odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | বৃহঃস্পতিবার, ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১৩ ভাদ্র ১৪৩২
দুই সংগঠনের ইগোতে পাল্টাপাল্টি আন্দোলনে জর্জরিত শিক্ষাঙ্গন

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই আন্দোলনের সমাপ্তি কোথায়?

odhikarpatra | প্রকাশিত: ২৮ আগস্ট ২০২৫ ০৪:৩৯

odhikarpatra
প্রকাশিত: ২৮ আগস্ট ২০২৫ ০৪:৩৯

বিশেষ প্রতিবেদন

বাংলাদেশে প্রকৌশল শিক্ষার অঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরে এক অদৃশ্য টানাপোড়েন বিরাজ করছে। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রিধারী B.Sc. Engineer, অন্যদিকে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে উত্তীর্ণ Diploma Engineer উভয়েই নিজেদের অবস্থানকে বৈধ ও মর্যাদাপূর্ণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান। সাম্প্রতিক সময়ে শাহবাগ অবরোধ এই দ্বন্দ্বকে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে। এর পেছনে মূলত একাডেমিক মর্যাদা ও পেশাগত স্বার্থ জড়িত। এর সমাধান সহসা দেখা যাচ্ছে না। বিষয়টি জটিল।

গত ১৮ এপ্রিল ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে ডিপ্লোমা স্তরের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে কারিগরি ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ কর্তৃক ছয় দফা দাবি ঘোষণা করা হয়। এর বিপরীতে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা “প্রকৌশল অধিকার আন্দোলন” ব্যানারে তিন দফা দাবি উত্থাপন করে। অন্যদিকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাক্রম ও শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কথিত ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে, বাংলাদেশ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র-শিক্ষক-পেশাজীবী সংগ্রাম পরিষদ এর মাধ্যমে সাত দফা দাবির বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টার নিকট স্মারকলিপি প্রদান করে। ২৭ আগস্ট এ কর্মসূচি পালন করা হয়।

ক্রমবর্ধমান পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি শিক্ষাঙ্গনকে অস্থির করে তুলছে, আর ভুক্তভোগী হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের তিন দফা দাবির বিপরীতে ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের রয়েছে সাত দফা দাবি। বিষয়টি এখন ন্যায্য দাবির চেয়ে বরং ‘ইগো’র লড়াইয়ে রূপ নিচ্ছে। ফলে আন্দোলনের সমাপ্তি তেমন সম্ভাবনাময় মনে হচ্ছে না। বাস্তবে, এটি দেশের দুই বৃহৎ পেশাজীবী সংগঠনের মর্যাদার দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে।

একদিকে ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং প্রায় ৪১,৫৪৫ জন সদস্য নিয়ে দেশের প্রাচীন ও বৃহৎ প্রকৌশলী সংগঠন ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইইবি) প্রকাশ্যে প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আজ (২৭ আগস্ট) বুয়েট উপাচার্যের সংহতি প্রকাশও এ প্রেক্ষাপটে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে, ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং প্রায় ৪ লক্ষ সদস্য নিয়ে দেশের বৃহত্তম পেশাজীবী সংগঠন ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি) ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি সরাসরি সমর্থন জানিয়েছে।

আইইবি ২৭ আগস্ট ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে এক বিবৃতিতে (স্মারক নং–সদ/আইইবি/জি/প্রেসবিঃ/২০২৫/২৩৭০) জানায়: “ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইইবি) দেশের স্বার্থে সর্বদা প্রকৌশল শিক্ষার্থী ও প্রকৌশলী সমাজের মর্যাদা, নিরাপত্তা ও ন্যায্য অধিকার রক্ষায় দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ এবং ভবিষ্যতেও এই ভূমিকা অব্যাহত রাখবে।”

অন্যদিকে, গত ১৯ এপ্রিল আইডিইবি এক যৌথ সভায় কারিগরি ছাত্র আন্দোলন কর্তৃক ঘোষিত ছয় দফাকে ন্যায্য দাবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে পূর্ণ সমর্থন জানায়। সেই সঙ্গে তারা আইডিইবির সকল পেশাজীবী সংগঠন, জেলা পর্যায়ের নেতৃত্ব এবং সদস্যদের আন্দোলনে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের আহ্বান জানায়। দাবিগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট মহলের লিয়াজোর স্বার্থে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, টিএসসি, টিটিসি, ভোকেশনাল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও আন্দোলনরত নেতৃবৃন্দকে নিয়ে আইডিইবির লিয়াজো কমিটি পুনর্গঠন করা হয়।

তাই বৃহৎ দুই পেশাজীবী সংগঠনের এই সংঘাতে একটি উভয় সংকটে ফেলেছে এই অন্তর্বর্তী সরকারকে। কাজী নজরুল ইসলামের ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ এর মতো এক মধুর কিন্তু গভীর সমস্যার অতলে পড়েছে সরকার। দেশ গভীর সংকটের সম্মুখীন, এ যেন সেই উপনিবেশিক আমলে বিহারের শাসনকর্তার ন্যায় অবস্থা। নজরুলের ভাষায় “বিহারের শাসনকর্তা লর্ড সিংহ বাহাদুর ভয়ানক মুশকিলে পড়িয়া গিয়াছেন। ঠিক যেন সাপে ছুঁচো গেলা গোছ। ছাড়িতেও পারেন না, গিলিতেও পারেন না। তাহা ছাড়া দেশের লোকের বর্তমান দাবি-দাওয়া পূর্ণ করাও তাঁহার ক্ষমতার বাহিরে। দেশীয় শাসনকর্তার নিকট দেশ-ভাই-এর একটু বেশি অধিকারের দাবি বাড়াবাড়ি বোধ হইলেও অন্তত অন্যায় নয়।” ঠিক তেমনি জনগণের কল্যাণে বৈষম্য মুক্ত রাষ্ট্র গড়তে যেহেতু দায়িত্ব নিয়েছেন বর্তমান সরকার, তাই জনগণতো একটু অধিকার ফলাবেই। আর তাই সৃষ্টি হয়েছে ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ এধরণের এক মধুর কিন্তু গভীর সমস্যার। কথায় কথায় আন্দোলন। এ যেন নজরুলের ভাষায় জনগণের মধুর বাণী, “আমরা তাঁহাকে আক্রমণ করিতেছি না, বরং তাঁহার এ ত্রিশঙ্কুর মতো অবস্থা দেখিয়া সহানুভূতি প্রকাশ করিতেছি। দোষ তাঁহারও নয়, আমাদেরও নয়, এ দোষ বুরোক্রাসির বা স্বেচ্ছাতন্ত্রের।” কেননা পেশাগত মর্যদার আলোকে চাকরি নিয়োগবিধি পরিমার্জন প্রয়োজন ছিল। আবার সরকারি সৃষ্ট পদসমূহের নিয়োগ যোগ্যতার  মানদন্ড (Competency Standards) আধনিকায়ন করা দরকার ছিল। যার যার যোগ্যতানুযায়ী পেশাগত মর্য াদা সংরক্ষণের উদ্যোগ প্রয়োজন ছিল।

এই আন্দোলনের সমাপ্তি নির্ভর করছে সকল পক্ষের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিতের মাধ্যমে ফলপ্রসূ উদ্যোগে। আর এই উদ্যোগের অন্যতম বিষয় হবে সরকারি চাকরিতে কারিগরি ও প্রকৌশল সম্পর্কিত পদসমুহের জনবল কাঠামো ও নিয়োগ যোগ্যতা হালনাগাদ করা। ১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকারের আমলে প্রণীত এনাম কমিটির সুপারিশ ও জনবল কাঠামো অনুযায়ী এখনো চলছে প্রায় সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তর। গত ৪২ বছরেও জনবল কাঠামো হালনাগাদ করতে পারেনি সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, পুরোনো কাঠামো দিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যুগের সাথে সাথে শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসছে। সিভিল সার্ভিসেও যোগ্যতার মানদণ্ডের পরিবর্তন তথা কম্পিটেন্সি স্ট্যৗান্ডার্ড পরিবতর্তিত হলেও তা আপগ্রেড করা হয়নি, যা জরুরি ভিত্তিতে করা দরকার। কিন্তু বাংলাপদেশে সিভিল সার্ভিসে এই উদ্যোগের অনুপস্থিত নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করছে। দেখা গেছে, যেসব দপ্তরের ক্ষমতা বেশি, তারা ইচ্ছামতো নতুন পদ সৃজন করে নিয়েছে। যেগুলোর ক্ষমতা কম, সেগুলোতে বিপুলসংখ্যক পদ শূন্য রয়েছে। এতে সরকারি কিছু অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দিনরাত কাজ করছেন, আবার অনেক অফিসে তেমন কাজের চাপ নেই। জানা যায়, সরকারি সব দপ্তরের টিওঅ্যান্ডই (টেবিল অব অর্গানাইজেশন অ্যান্ড ইকুইপমেন্টস) যুগোপযোগী ও হালনাগাদকরণের লক্ষ্যে সরকার বহুবার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু দপ্তর, অধিদপ্তরসহ পুরোপুরিভাবে একটি মন্ত্রণালয়ও জনবল হালনাগাদ করতে পারেনি।

সমাধানের পথ

এই দ্বন্দ্বের সমাধান এক পক্ষকে বাদ দেওয়ার মধ্যে নয়, বরং দায়িত্বের ক্ষেত্র পেশাগত পরিচয় সুস্পষ্ট করার মধ্যেই নিহিত। যা হতে পারে নিম্নরূপ ধারণার আলোকে:

  • বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিত প্রকৌশলীরা হবেন পরিকল্পনা, গবেষণা ও নকশার দায়িত্বশীল।
  • ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা হবেন বাস্তবায়ন ও মাঠপর্যায়ের কারিগরি দায়িত্বশীল।
  • পদোন্নতি ও চাকরির কাঠামোতে এ বিভাজন প্রতিফলিত করতে হবে।

বি.দ্র.

বুয়েটসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল শিক্ষার্থীরা রাজপথে কেন’ তা জানতে পড়ুন বিশেষ সম্পাদকীয় নোট (Editorial Note) কনফ্লিক্ট অব ডিসসিপ্লিন: একাডেমিক মর্যাদা বনাম প্রফেশনাল স্বার্থ (https://odhikarpatra.com/news/31634)

এবং প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন বুঝতে পড়ুন ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং বনাম বিএসসি ইন ইঞ্জিনিয়ারিং: যোগ্যতার পার্থক্য ও প্রেক্ষাপট (https://odhikarpatra.com/news/31633)

 

— লেখক: . মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান (লিটু), অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপদেষ্টা সম্পাদক, আমাদের অধিকা্রপত্র, odhikarpatranews@gmail.com



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: