odhikarpatra@gmail.com ঢাকা | Friday, 14th November 2025, ১৪th November ২০২৫
আত্মবিশ্বাসী হোন। কোনো অবস্থাতেই আত্মসম্মান ও ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিবেন না।

আপনি ডিভোর্সি? অসুবিধা কী? হীনমন্য হয়ে পড়ে থাকার কিছু নাই। স্বাবলম্বী হোন।

odhikar patra | প্রকাশিত: ১১ August ২০১৯ ০৪:১০

odhikar patra
প্রকাশিত: ১১ August ২০১৯ ০৪:১০

কোনো মেয়ের যখন ডিভোর্স হয় তখন সবাই ভাবে, দোষ মেয়েটিরই। অথচ, ডিভোর্স হওয়া বা দেয়াটা দোষের কিছু নয়। হ্যাঁ, সুখী-সুন্দর দাম্পত্য জীবন হলে তো খুবই ভালো। না হলে? ধুঁকে ধুঁকে মরা? ভুল মানুষের সাথে জীবন কাটিয়ে দেয়া? যে সমাজ নারীদেরকে পুরুষের সমকক্ষ তথা সমানে সমান মানুষ হিসাবে না দেখে পুরুষদের জীবনসঙ্গী হিসাবেই দেখতে অভ্যস্ত, সে সমাজে জামাইয়ের ঘরে উন্নতমানের দাসী হয়ে থাকাটাই তো নারীদের উপায়! তালাক দিলে যেন পুরুষেরাই দিবে। বউ জামাইকে তালাক দিবে, এটি কেমন যেন ঠিক নয়! যুগের প্রভাব(?) কিংবা বাড়াবাড়ি। যেন চাকরি করার কারণে মেয়েগুলো ‘নষ্ট’ হয়ে গেছে। তাই জামাইদেরকে তারা মানতে চাচ্ছে না।

দাম্পত্য সমস্যা নিয়ে আজকের আলাপে শুধু এই একটা পয়েন্টে কথা বলবো। অত্যন্ত সংক্ষেপে।

নানা কারণে ডিভোর্স হতে পারে। ডিভোর্সের জন্য নারীও দায়ী হতে পারে। পুরুষও দায়ী হতে পারে। আবার দুজনের কেউ দায়ী না হয়ে তাদের পরিবারের অন্য কেউ হতে পারে ফ্যামিলি ভেংগে যাওয়ার কারণ। ছাড়াছাড়ি হতে পারে পরকীয়ার কারণে। হতে পারে, স্রেফ মন-মানসিকতার মিল না থাকায়। জামাই-বউ দুজনেই ভালো মানুষ হওয়া সত্ত্বেও।

পাশ্চাত্য সমাজে যেভাবে প্রচলিত, প্রাকবিবাহ ‘যাচাই’ পর্বের পরে তাদের আর বিয়েটাই করা হয়ে উঠে না। বিয়ের আগেই ‘সবকিছু’ সম্ভবপর হলে বিয়ের আর দরকার কী? এরপরও এ ধরনের মুক্তমনা কোনো কাপল বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হলে তাদের মধ্যে বিয়ের পর যে মুগ্ধতা আর আকর্ষণ থাকার কথা, তা থাকে না। তাই নিতান্তই ব্যতিক্রম বাদে এ ধরনের এফেয়ার ম্যারেজগুলো জোড়াতালি দিয়ে মূলত লিভিং-টুগেদার ফরমেটে টিকে থাকে।

অপরদিকে, অ্যারেঞ্জড বিয়ে তথা পারিবারিকভাবে অনুষ্ঠিত বিয়েতেও হতে পারে বনাবনি না হওয়ার সমস্যা। হতে পারে, কোথাও যেন দুজনের মিলছে না। ব্যক্তিগত অভিরুচির পার্থক্য বা যে কারণেই হোক না কেন, ব্যাটে-বলে ঠিক মতো না মিললে ডিভোর্স নেয়া বা দেয়াই হচ্ছে সহজতর উপায়। পরকীয়ার ঝুঁকি এড়ানো ও জীবনের নানাবিধ ফলোআপ জটিলতা হতে বাঁচার জন্য এটি বেটার সলিউশন।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে কোনো মেয়ে যখন বাধ্য হয়ে ডিভোর্স নেয় বা দেয়, তখন এমনকি তার মা-বাবাও বিষয়টাকে খুব একটা সহজভাবে গ্রহণ করে না। বিরল ব্যতিক্রম বাদে। ডিভোর্সি নারীর যদি সন্তান থাকে তাহলে তো ভিতরে ভিতরে তার জীবন হয়ে উঠে কঠিন, ক্ষেত্রবিশেষে দুর্বিষহ। সন্তান আছে এমন নারীর পুনর্বিবাহ এ সমাজে এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। যদিওবা তার বিয়ে হয়, তাকে সাধারণত কোনো ডিভোর্সি পুরুষের ঘর করতে হয়। সেই লোকের আগের ঘরের সন্তান থাকুক বা না থাকুক, খুব কম পুরুষই বউয়ের আগের ঘরের সন্তানদের নিজের সন্তানের মতো করে গ্রহণ করে। অন্যদিকে মাতৃত্বের সহজাত প্রবৃত্তির কারণে একজন মা কখনোই তার সন্তানকে অবহেলা করতে পারে না। অথবা নিজের সন্তান অবহেলিত হতে পারে, এমন কোনো পরিস্থিতিকেও সে মেনে নিতে পারে না। এমতাবস্থায় সেই নারীকে মুখোমুখি হতে হয় এক মানবিক উভয় সংকটের।

ডিভোর্সি মেয়েদের সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় পরিচয় দিতে গিয়ে। এটি শুধু ডিভোর্সি মেয়েদেরই সমস্যা নয়। এটি লেখাপড়া শেষ হয়ে গেছে, অথচ বিয়ে হয়নি এখনো, এমন মেয়েদেরও অন্যতম সামাজিক সমস্যা। আসলে আমাদের সমাজ-মননটাই দূষিত। তাই এই সমস্যা। ভাবখানা এমন, নারীদের যেন জন্মই হয়েছে বিবাহিত হওয়ার জন্য। সংসার করার জন্য। মা হওয়ার জন্য। কোনো কারণে যাদের এসব বিষয়ের কোনো একটিতে সমস্যা হচ্ছে বা হয়েছে, সবার ভাবখানা এমন যেন তার জীবন ব্যর্থ হয়ে গেছে। এটি যেন তারই দোষ। যেন এক বিরাট পার্সোনাল ডিসক্রেডিট।

যে মেয়ের বিয়ে ভেংগে গেছে, কারণ যা-ই হোক, অ্যাট দ্যা ফার্স্ট চান্স, লোকেরা মনে করে, মেয়েটা নিশ্চয়ই খারাপ। যেন সে মোটেও সংসারী নয়। মাত্রাতিরিক্ত ইনটলারেন্ট ইত্যাদি। যদিও এ কথা সত্য, যেসব মেয়ে কোনো বলকেই মাটিতে পড়তে দিতে নারাজ, যারা সব সময় সবকিছুতেই জয়ী হতে চায়, সমঝোতার ঔদার্য যাদের মধ্যে কম, তাদের সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি। জামাই যদি অতীব নিরীহ, ভদ্র, স্ত্রৈণ বা নপুংসক-বৈশিষ্ট্যের না হয়।

পুরুষের মধ্যে পৌরষত্ব থাকবে। সে ডমিনেট করবে। এটাই স্বাভাবিক। কোনো নারীই নতজানু স্বভাবের ও ব্যক্তিত্বহীন পুরুষকে পছন্দ করে না। সমস্যা হলো, আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষসুলভ ব্যক্তিত্বকে পুরুষতান্ত্রিকতার সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়। পুরুষতান্ত্রিকতা হলো অত্যাচার ও অবৈধ ক্ষমতাচর্চার প্রতীক। সে হিসাবে, একজন অত্যাচারী নারীও কিন্তু পুরুষতন্ত্রী। এমনকি তিনি যদি নিজেকে নারীবাদী হিসাবে দাবি করেন, তাহলেও।

আমরা চাইতেছি, সুস্থ, স্বাভাবিক, সুন্দর ও সুখী মানবজীবন। চেক এন্ড ব্যালেন্স সমাজ। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আর্লি ম্যারেজের প্রচলন ঘটানোর কোনো বিকল্প নাই। ক্যারিয়ার কিংবা সংসার, এই ফলস বাইনারি হতে তরুণদের মুক্তি দিতে হবে। আর্লি ম্যারেজ আর অধিকতর হারে ডিভোর্স, এই দুইটা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সুস্থ সমাজ মানেই সহজ ডিভোর্সের সুযোগ ও ডিভোর্সিদের বিয়ের সুব্যবস্থা। যে সমাজ মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতিসম্মত জীবনযাপনে সহায়ক নয় তা অসুস্থ ও ভারসাম্যহীন। যেমন আমাদের এখনকার এই বাংলাদেশ সমাজ। এই অসুস্থ সমাজের অচলায়তন ভেংগে নতুন এক ভারসাম্যপূর্ণ সামাজিক কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি। আমাকে, আপনাকে, প্রত্যেক বিবেকবান মানুষকে হতে হবে সমাজ পরিবর্তনের এই কাজে আন্তরিক, সোচ্চার ও সক্রিয়।

সফল বৈবাহিক সম্পর্কের জন্য কোনো একটা ফর্মূলা দিয়ে বলা যায় না, এটিই সুখী হওয়ার একমাত্র ও সহজ পথ। মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং ব্যতিরেকে দাম্পত্য জীবনের কোনো মডেল বা প্যাটার্নেই সুখী হওয়ার গ্যারান্টি নাই। সফল দাম্পত্য জীবনের শর্ত হলো, প্রত্যেকে যার যার সীমার মধ্যে থেকে যথাসম্ভব নিজ কর্তব্য পালন করা এবং নিজের অধিকার আদায় করে নেয়া। শুনতে খারাপ লাগলেও এ কথা সত্য, সুখী দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসা থাকা জরুরি কিছু নয়। থাকলে ভালো। না থাকলেও চলে। এতে বিশেষ কোনো সমস্যা নাই। পক্ষদ্বয় যদি নিজ নিজ দায়িত্ব ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকে।

রাস্তা দিয়ে আপনি সতর্ক হয়ে চলবেন। ভালো কথা। নিরাপদ থাকবেন। কিন্তু, যতই আপনি সতর্ক থাকেন না কেন, আরেকজনের ভুলের কারণেও আপনি দুর্ঘটনার শিকার হতে পারেন। তেমনি করে পারিবারিক জীবনেও কোনো পক্ষ নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও পরিস্থিতির শিকার হতে পারে। যে কোনো সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিয়ে ভেংগে যাওয়ার জন্য এমনকি আপনার মেয়ে বা বোনটি যদি নিজেই দায়ী হয়, তাহলেও আপনার উচিত হবে, সংসার ছেড়ে চলে আসা নারীটিকে আশ্বস্ত করা। সহৃদয়ে ও সম্মান দিয়ে তাকে আগের মতো পরিবারের একজন হিসেবে আপন করে নেয়া। এবং সে তার পরবর্তী জীবনের জন্য যেটাকে ভালো মনে করবে, সেটার জন্যে তাকে সহযোগিতা করা।

এজন্য অবশ্য ডিভোর্সি মেয়েটির মা কিংবা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে তার ভাইয়ের বউয়ের পজিটিভ মানসিকতা ও সহযোগিতা থাকা জরুরি। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের এমনকি মুসলিম সমাজেও বিয়ে দিয়ে দেয়ার পরে মেয়েদেরকে শুধু ‘নাইওরি’ ভাবা হয়। নিজের পিতার ঘরেও সে আর তেমন করে সন্তানের অধিকার ফিরে পায় না।

হানাফী মজহাব অনুসারে, অবিবাহিত মেয়েদের বিয়েতে অভিভাবকের সম্মতি থাকা ভালো। না থাকলেও বিয়ে শুদ্ধ হবে। অন্য মাজহাবে অভিভাবকের সম্মতি না থাকলে কুমারী মেয়ের বিয়ে আইনসম্মত হবে না। কিন্তু এ ব্যাপারে সব মাজহাবই একমত যে অ-কুমারী নারীর বিয়েতে অভিভাবকের সম্মতি থাকার অপরিহার্যতা নাই। কেননা, ইতোমধ্যে সে দাম্পত্যজীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। নিজের ভালোমন্দ বুঝার ক্যাপাসিটি তার হয়েছে। এখানে এ কথা বলার উদ্দেশ্য হলো, ডিভোর্সি নারীদের উচিত নিজের পুনর্বিবাহের জন্য সচেষ্ট হওয়া। উপযুক্ত সংগী খুঁজতে থাকা। একাকী থাকার ঝুঁকি এড়ানোর চেষ্টা করা।

হ্যাঁ, আপনার একাকী জীবনে আপনি নিজেই নিজের জন্য সবচেয়ে বড় রিস্ক-ফ্যাক্টর। প্রকৃতি কাউকে রেহাই দেয় না। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বিয়ে না হওয়া বা না করা, স্বামী বা স্ত্রী মারা যাওয়া কিংবা বিবাহ বিচ্ছেদের পরে যারাই বলেছে, “ওসব কিছু না, আমি সামলিয়ে চলতে পারবো”, এদের কেউই, অন্যদের কাছ থেকে যা-ই হোক, নিজের কাছ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেনি। আজকে যেহেতু শুধু এই পয়েন্টেই কথা বলবো বলে শুরুতে বলেছি, তাই এ মুহূর্তে অন্য কোনো পয়েন্টে ফোকাস করা সমীচীন মনে করছি না।

আমার কথার মানে অবশ্য এমন নয় যে, ডিভোর্সি নারীদের পুনর্বিবাহের জন্য তাদের অভিভাবকদের কিছু করার দরকার নাই। অভিভাবকদের দিক থেকে দেখলে, বিশেষ করে আমাদের এই নারী-প্রতিকুল সামাজিক বাস্তবতায়, একটা মেয়েকে প্রথমবার বিয়ে দেয়ার চেয়েও তার পুনর্বিবাহের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের দায়িত্ব বরং আরো বেশি।

এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, বিশেষ করে এই নিবর্তনমূলক সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যবস্থার যাঁতাকলে পড়ে একজন ডিভোর্সি নারী কতটা যে অসহায়, বিব্রতকর ও নাজুক পরিস্থিতিতে থাকে তা আমি খুব বুঝতে পারি। তাই তো চাই, সব ধরনের বাহুল্য লৌকিকতার, ব্যক্তিগত হীনমন্যতাবোধ ও ততোধিক বোগাস সামাজিকতাকে পরিহার করে প্রতিটা মানুষ, বিশেষ করে (অন্যতম ভালনারেবল জনগোষ্ঠীর সদস্য হওয়ার কারণে) প্রত্যেক নারী স্বাবলম্বী জীবনযাপন করুক। তারা স্বাধীন হয়ে উঠুক। পারিবারিক জীবন এ ক্ষেত্রে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ানোর কথা নয়। নারীদের সামাজিক অবস্থানের এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য উচিত হলো, যাদের চাকরি নাই, নিজস্ব সম্পদ নাই, স্বাবলম্বী হওয়ার মতো কোনো কিছু নাই, আয়-উপার্জনের কোনো একটা উপায় বের করার কাজে এখনি লেগে পড়া। আপাতত বিশেষ প্রয়োজন না থাকলেও।

আপনি ডিভোর্সি? অসুবিধা কী? হীনমন্য হয়ে পড়ে থাকার কিছু নাই। স্বাবলম্বী হোন। আত্মবিশ্বাসী হোন। কোনো অবস্থাতেই আত্মসম্মান ও ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিবেন না। আরো ভালো বিয়ে আপনার হবেই, ইনশাআল্লাহ। না হলেও আপনার জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে না। যারা বিয়ে করেনি কিংবা যাদের বিয়ে ভেঙে গেছে তারা বেহেশতে যেতে পারবে না, এমন তো নয়। তাই না?



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: